নয়াদিল্লি, ৫ আগস্ট ২০২৫: রাশিয়া সম্প্রতি ১৯৮৭ সালে স্বাক্ষরিত ইন্টারমিডিয়েট-রেঞ্জ নিউক্লিয়ার ফোর্সেস (আইএনএফ) চুক্তি থেকে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত ঘোষণা করেছে, যা বিশ্বজুড়ে উত্তেজনা বাড়িয়েছে। এই চুক্তি, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়ার মধ্যে ৫০০ থেকে ৫,৫০০ কিলোমিটার রেঞ্জের স্থলভিত্তিক ক্ষেপণাস্ত্র নিষিদ্ধ করেছিল, ২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যাহারের পর থেকেই কার্যত অকার্যকর হয়ে পড়েছিল। রাশিয়ার এই সিদ্ধান্তকে পশ্চিমা দেশগুলোর, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েনের প্রতিক্রিয়া হিসেবে দেখা হচ্ছে। এই ঘটনা বিশ্বে পারমাণবিক হুমকির নতুন আশঙ্কা তৈরি করেছে, এবং ভারত এই পরিস্থিতিতে একটি সতর্ক ও কৌশলগত অবস্থান গ্রহণ করছে।
রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, পশ্চিমা দেশগুলোর ক্রিয়াকলাপ, বিশেষ করে ফিলিপাইনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টাইফন ক্ষেপণাস্ত্র লঞ্চার মোতায়েন এবং অস্ট্রেলিয়ায় তালিসমান সাব্রে সামরিক মহড়ায় ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা, তাদের নিরাপত্তার জন্য “সরাসরি হুমকি” সৃষ্টি করেছে। রাশিয়ার এই ঘোষণা এমন এক সময়ে এসেছে যখন মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প রাশিয়ার প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি দিমিত্রি মেদভেদেভের “উত্তেজক মন্তব্যের” জবাবে দুটি পারমাণবিক সাবমেরিন মোতায়েনের নির্দেশ দিয়েছেন। মেদভেদেভ ট্রাম্পের ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য দেওয়া আলটিমেটামকে “যুদ্ধের দিকে পদক্ষেপ” হিসেবে অভিহিত করেছেন। এই ঘটনাগুলো বিশ্বে পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার নিয়ে উদ্বেগকে নতুন করে উসকে দিয়েছে।
ভারতের দৃষ্টিভঙ্গি
ভারত এই ঘটনাকে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করছে। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এখনও এই বিষয়ে আনুষ্ঠানিক বিবৃতি প্রকাশ করেনি, তবে কূটনৈতিক সূত্র জানায়, ভারত পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার বা এর হুমকির বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান বজায় রাখছে। ভারতের দীর্ঘদিনের পারমাণবিক নীতি হলো “নো ফার্স্ট ইউজ” (প্রথমে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার না করা) এবং ন্যূনতম বিশ্বাসযোগ্য প্রতিরোধ ক্ষমতা বজায় রাখা। ২০২২ সালে ইউক্রেন যুদ্ধের সময় রাশিয়ার পারমাণবিক হুমকির প্রেক্ষিতে ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং রাশিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগুকে স্পষ্টভাবে সতর্ক করে বলেছিলেন, পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার “মানবতার মৌলিক নীতির বিরুদ্ধে”।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি রাশিয়ার রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে কথোপকথনের মাধ্যমে ইউক্রেন যুদ্ধে পারমাণবিক উত্তেজনা কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন বলে প্রাক্তন সিআইএ প্রধান উইলিয়াম জে. বার্নস জানিয়েছেন। ভারতের এই কূটনৈতিক প্রচেষ্টা বিশ্বে তার ক্রমবর্ধমান প্রভাবের প্রমাণ। তবে, রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের দীর্ঘদিনের কৌশলগত অংশীদারিত্ব এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ক্রমবর্ধমান সহযোগিতার মধ্যে ভারত একটি সূক্ষ্ম ভারসাম্য বজায় রাখছে।
ভারতের জন্য এই পরিস্থিতি জটিল কারণ রাশিয়া তার প্রাচীনতম প্রতিরক্ষা ও পারমাণবিক সহযোগিতার অংশীদার। কুদানকুলাম পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার মতো প্রকল্পে রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের গভীর সহযোগিতা রয়েছে। তবে, চীনের সঙ্গে রাশিয়ার ক্রমবর্ধমান ঘনিষ্ঠতা এবং পাকিস্তানের সঙ্গে রাশিয়ার নতুন সামরিক সম্পর্ক ভারতের জন্য উদ্বেগের বিষয়।
বিশ্বব্যাপী হুমকি ও প্রভাব
রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে পারমাণবিক চুক্তি বাতিল বিশ্বব্যাপী নিরাপত্তা কাঠামোকে আরও দুর্বল করেছে। ২০২৩ সালে রাশিয়া নিউ স্টার্ট চুক্তি থেকে নিজেকে স্থগিত করার ঘোষণা দেওয়ার পর থেকে পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের কাঠামো ক্রমশ ভেঙে পড়ছে। এই চুক্তি রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে দূরপাল্লার পারমাণবিক অস্ত্রের সংখ্যা সীমিত করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই বাতিলের ফলে উভয় দেশই তাদের পারমাণবিক অস্ত্রাগার বাড়াতে পারে, যা একটি নতুন পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতার সূচনা করতে পারে।
চীনের পারমাণবিক অস্ত্রাগার বৃদ্ধি এবং রাশিয়ার সঙ্গে তার কৌশলগত অংশীদারিত্ব ভারতের জন্য অতিরিক্ত উদ্বেগের কারণ। ভারতের প্রতিবেশী পাকিস্তানও পারমাণবিক শক্তিধর দেশ, এবং এই অঞ্চলে পারমাণবিক উত্তেজনা বৃদ্ধি ভারতের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সীমিত পারমাণবিক সংঘর্ষেও এক বিলিয়ন মানুষ ক্ষুধা ও খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার ঝুঁকিতে পড়তে পারে।
বিশ্ব নেতাদের প্রতিক্রিয়া
ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ পারমাণবিক বক্তৃতায় সতর্কতার আহ্বান জানিয়েছেন, যখন ট্রাম্পের সাবমেরিন মোতায়েনের ঘোষণাকে বিশ্লেষকরা কৌশলগত সংকেত হিসেবে দেখছেন। ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং ন্যাটো এই পরিস্থিতিকে গভীর উদ্বেগের সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং রাশিয়ার রাষ্ট্রপতি পুতিনের মধ্যে সাম্প্রতিক বৈঠকগুলোতে শান্তি ও স্থিতিশীলতার উপর জোর দেওয়া হয়েছে, এবং ভারত বিশ্বাস করে যে কূটনৈতিক আলোচনাই এই সংকটের সমাধান করতে পারে।
ভারতের জন্য এই পরিস্থিতি একটি কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ। রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক ঐতিহাসিকভাবে শক্তিশালী, এবং রাশিয়া ভারতের পারমাণবিক শক্তি ও প্রতিরক্ষা খাতে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। একই সঙ্গে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের ক্রমবর্ধমান সহযোগিতা, বিশেষ করে কোয়াড এবং ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের মাধ্যমে, ভারতকে একটি জটিল ভারসাম্য বজায় রাখতে হচ্ছে। সম্প্রতি ট্রাম্প ভারতের বিরুদ্ধে রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যের জন্য সমালোচনা করেছেন এবং সম্ভাব্য নিষেধাজ্ঞার হুমকি দিয়েছেন, যা ভারতের কূটনৈতিক অবস্থানকে আরও জটিল করেছে।
ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রী স্পষ্ট করেছেন,
“ভারতের জ্বালানি নিরাপত্তা আমাদের শীর্ষ অগ্রাধিকার, এবং আমরা পশ্চিমা চাপের কাছে মাথা নত করব না।”
পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস. জয়শঙ্করও বলেছেন,
“ভারতের নীতি ভারতে তৈরি হয়, ওয়াশিংটন বা ব্রাসেলসে নয়।”
এই অবস্থান ভারতের বহুমুখী কূটনীতির প্রতিফলন, যেখানে ভারত রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র উভয়ের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখতে চায়।
রাশিয়া-যুক্তরাষ্ট্র পারমাণবিক চুক্তি বাতিল বিশ্বে একটি নতুন পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতার আশঙ্কা তৈরি করেছে। ভারত এই পরিস্থিতিতে শান্তি ও কূটনৈতিক সমাধানের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে, যা তার অ-প্রথম ব্যবহার নীতি এবং বিশ্ব শান্তির প্রতি প্রতিশ্রুতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তবে, রাশিয়ার সঙ্গে ঐতিহাসিক সম্পর্ক এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কৌশলগত অংশীদারিত্বের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা ভারতের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। বিশ্ব এখন ভারতের মতো প্রভাবশালী দেশগুলোর কাছ থেকে শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য কূটনৈতিক নেতৃত্ব আশা করছে।

