যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে বিপর্যয়, পাইলটের সাহসী প্রচেষ্টা সত্ত্বেও শিশুদের জীবন রক্ষা করা গেল না
ঢাকা, ২২ জুলাই ২০২৫: বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ক্যাম্পাসে সোমবার (২১ জুলাই) বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ বিমান (এফ-৭ বিজিআই) বিধ্বস্ত হয়েছে। এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় কমপক্ষে ২৭ জন নিহত এবং ১৭১ জন আহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে বেশিরভাগই স্কুলের শিক্ষার্থী। নিহতদের মধ্যে ২৫ জন শিশু এবং একজন শিক্ষক ছিলেন, এবং বিমানের পাইলট ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মোহাম্মদ তৌকির ইসলামও প্রাণ হারিয়েছেন। এটি ঢাকার সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনা। দুর্ঘটনার পর বাংলাদেশ সরকার মঙ্গলবার (২২ জুলাই) জাতীয় শোক দিবস ঘোষণা করেছে, এবং সারাদেশে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়েছে। এই প্রতিবেদনে আমরা দুর্ঘটনার বিস্তারিত, কারণ, হতাহতের তথ্য, এবং সর্বশেষ আপডেট নিয়ে আলোচনা করব।
দুর্ঘটনার বিবরণ: কী ঘটেছিল?
২১ জুলাই, সোমবার দুপুর ১:০৬ মিনিটে (বাংলাদেশ সময়) বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর কুর্মিটোলা এয়ার ফোর্স বেস থেকে এফ-৭ বিজিআই প্রশিক্ষণ বিমানটি নিয়মিত প্রশিক্ষণ মিশনের জন্য উড্ডয়ন করে। বিমানটি উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ক্যাম্পাসে দুপুর ১:১৮ মিনিটে বিধ্বস্ত হয়। বিমানটি প্রথমে স্কুলের সাততলা ভবনের ছাদে আঘাত করে এবং পরে দোতলা হাইদার আলী ভবনের মূল ফটকে আছড়ে পড়ে। দুর্ঘটনার সময় স্কুলে নার্সারি থেকে তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ক্লাস চলছিল। বিমানটি ভবনের একপাশ দিয়ে প্রবেশ করে অন্যপাশে বেরিয়ে যায়, যার ফলে ভবনে বড় একটি গর্ত এবং তীব্র আগুনের সৃষ্টি হয়।
বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর ইন্টার-সার্ভিসেস পাবলিক রিলেশনস (আইএসপিআর) বিবৃতিতে জানিয়েছে, বিমানটি উড্ডয়নের কিছুক্ষণ পরেই যান্ত্রিক ত্রুটির সম্মুখীন হয়। পাইলট মোহাম্মদ তৌকির ইসলাম ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা এড়িয়ে বিমানটিকে কম জনবহুল এলাকার দিকে নিয়ច
হতাহতের তথ্য
দুর্ঘটনায় নিহতদের মধ্যে ২৭ জনের মধ্যে ২৫ জনই শিশু, যাদের বয়স ১০ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে, এবং একজন শিক্ষক। পাইলট তৌকির ইসলামও দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান। আহত ১৭১ জনের মধ্যে কমপক্ষে ৪৩ জন শিশু, এবং তাদের মধ্যে ২৫ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। আহতদের মধ্যে অনেকেই জেট ফুয়েলের কারণে গুরুতর পোড়া জখমে ভুগছেন। আহতদের ঢাকার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি, কম্বাইন্ড মিলিটারি হাসপাতাল (সিএমএইচ), এবং উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।

দুর্ঘটনার কারণ
বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর বিবৃতি অনুসারে, এফ-৭ বিজিআই বিমানটি চীনের চেংদু কর্পোরেশনের তৈরি একটি মাল্টি-রোল প্রশিক্ষণ বিমান, যা ২০১৩ এবং ২০২২ সালে বাংলাদেশের জন্য সরবরাহ করা হয়েছিল। দুর্ঘটনার প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে, বিমানটি যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে বিধ্বস্ত হয়। আইএসপিআর জানিয়েছে, পাইলট তৌকির ইসলাম ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা এড়াতে চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু তাঁর প্রচেষ্টা সত্ত্বেও বিমানটি স্কুলের ভবনে আছড়ে পড়ে। দুর্ঘটনার সঠিক কারণ জানতে বিমান বাহিনী একটি উচ্চ-পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে, যারা বিমানের ফ্লাইট রেকর্ডার, রক্ষণাবেক্ষণের লগ, এবং পাইলটের যোগাযোগ বিশ্লেষণ করছে।
এফ-৭ বিজিআই হল চীনের জে-৭ বিমানের একটি উন্নত সংস্করণ, যা সোভিয়েত মিগ-২১ এর লাইসেন্সড সংস্করণ। এই বিমানটি তিনটি মাল্টিফাংশন ডিসপ্লে এবং উন্নত ফায়ার-কন্ট্রোল রাডার দিয়ে সজ্জিত। তবে, বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, নিম্ন উচ্চতায় প্রশিক্ষণ উড্ডয়নের সময় এই ধরনের বিমানে যান্ত্রিক ত্রুটি মারাত্মক হতে পারে, যা এই দুর্ঘটনায় প্রমাণিত হয়েছে।
উদ্ধার ও ত্রাণ কার্যক্রম
দুর্ঘটনার পরপরই বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স দল ঘটনাস্থলে পৌঁছে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। আটটি ফায়ার ইউনিট, বিমান বাহিনী, সেনাবাহিনী, পুলিশ, এবং বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) যৌথভাবে উদ্ধার কার্যক্রমে অংশ নেয়। আহতদের হেলিকপ্টার, অ্যাম্বুলেন্স, এবং রিকশার মাধ্যমে দ্রুত হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। একটি ক্রেন দিয়ে ধ্বংসাবশেষ সরিয়ে বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিদের উদ্ধারের চেষ্টা চালানো হয়।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের প্রধান বিধান সরকার জানিয়েছেন, “একজন তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র মৃত অবস্থায় আনা হয়েছিল, এবং ১২, ১৪ এবং ৪০ বছর বয়সী তিনজন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।” তিনি জানান, আহতদের মধ্যে অনেকের অবস্থা গুরুতর, এবং তাদের মধ্যে বেশিরভাগই পোড়া জখমে ভুগছেন।
দুর্ঘটনার খবর ছড়িয়ে পড়ার পর হাজার হাজার মানুষ ঘটনাস্থলে ভিড় করেন। অনেক অভিভাবক তাদের সন্তানদের খুঁজতে হাসপাতালে ছুটে যান। একজন অভিভাবক, শাহবুল, কান্নায় ভেঙে পড়েন, জানান, “আমার মেয়ে নিখোঁজ। আমি এখানে এসে শুধু আগুন আর ধোঁয়া দেখেছি।” স্থানীয় শিক্ষক মাসুদ তারিক বলেন, “আমি গেটের কাছে ছিলাম, হঠাৎ একটি বিস্ফোরণের শব্দ শুনলাম। পেছনে তাকাতেই আগুন আর ধোঁয়া দেখলাম।”
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান মুহাম্মদ ইউনুস এক্স-এ একটি পোস্টে
“গভীর শোক ও দুঃখ” প্রকাশ করে বলেন, “বিমান বাহিনী, শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শিক্ষক এবং কর্মীদের এই ক্ষতি অপূরণীয়।”
তিনি দুর্ঘটনার তদন্ত এবং আহতদের জন্য সব ধরনের সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এক্স-এ শোক প্রকাশ করে বলেন, “ঢাকার বিমান দুর্ঘটনায় প্রাণহানি, বিশেষ করে অল্পবয়সী শিক্ষার্থীদের মৃত্যুতে গভীরভাবে শোকাহত। ভারত বাংলাদেশের পাশে রয়েছে এবং সব ধরনের সহায়তা প্রদানের জন্য প্রস্তুত।”

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি পরিদর্শন করে শোক প্রকাশ করেন। বাংলাদেশি ক্রিকেটার শাকিব আল হাসান, তামিম ইকবাল, এবং পাকিস্তানি ক্রিকেটার শাহিন আফ্রিদিসহ অনেক ক্রীড়াবিদ দুর্ঘটনার জন্য শোক প্রকাশ করেছেন।
দুর্ঘটনার তাৎপর্য ও পূর্বের ঘটনা
এই দুর্ঘটনা বাংলাদেশের ইতিহাসে সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে মারাত্মক বিমান দুর্ঘটনা। ১৯৮৪ সালে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকাগামী একটি যাত্রীবাহী বিমান বর্ষার সময় বিধ্বস্ত হয়ে ৪৯ জন নিহত হয়েছিল। ২০০৮ সালে আরেকটি এফ-৭ প্রশিক্ষণ বিমান ঢাকার বাইরে বিধ্বস্ত হয়ে পাইলট নিহত হয়েছিলেন। বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, বাংলাদেশের বিমান বাহিনীর পুরনো বিমান এবং নিম্ন উচ্চতায় প্রশিক্ষণ উড্ডয়নের ঝুঁকি এই ধরনের দুর্ঘটনার সম্ভাবনা বাড়ায়।
সরকারি পদক্ষেপ ও তদন্ত
বাংলাদেশ সরকার জরুরি হটলাইন চালু করেছে এবং নিহতদের পরিচয় নিশ্চিত করতে ডিএনএ পরীক্ষার ব্যবস্থা করেছে। মুহাম্মদ ইউনুস জানিয়েছেন, পরিচয় নিশ্চিত হওয়া মৃতদেহগুলো দ্রুত পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হবে। তদন্ত কমিটি বিমানের রক্ষণাবেক্ষণ, পাইলটের প্রশিক্ষণ, এবং দুর্ঘটনার সময়ের পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করছে। সামরিক বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, এই তদন্তের ফলাফল বিমান বাহিনীর প্রশিক্ষণ প্রক্রিয়া এবং বিমান রক্ষণাবেক্ষণে বড় পরিবর্তন আনতে পারে।
ঢাকার মাইলস্টোন স্কুলে বিমান দুর্ঘটনা বাংলাদেশের জন্য একটি অপূরণীয় ক্ষতি। শিশুদের মৃত্যু এবং ব্যাপক আহতের ঘটনা দেশজুড়ে শোকের ছায়া ফেলেছে। পাইলট তৌকির ইসলামের সাহসী প্রচেষ্টা সত্ত্বেও এই বিপর্যয় ঠেকানো যায়নি। এই ঘটনা সামরিক বিমানের নিরাপত্তা এবং ঘনবসতিপূর্ণ এলাকার উপর দিয়ে প্রশিক্ষণ উড্ডয়নের ঝুঁকি নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলেছে। বাংলাদেশ এখন শোকের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে, এবং সরকার ও জনগণ একসঙ্গে আহতদের পাশে দাঁড়িয়েছে।

