মমতার হস্তক্ষেপে শ্রমিকদের মুক্তি, মুখ্যমন্ত্রী বিজেপির বিরুদ্ধে তুললেন গুরুতর অভিযোগ
কলকাতা, ২৬ জুলাই ২০২৫: হরিয়ানার গুরুগ্রাম এবং ফরিদাবাদে বাংলাদেশি সন্দেহে আটক হওয়া পশ্চিমবঙ্গের ৩০ জন পরিযায়ী শ্রমিক মুক্তি পেয়েছেন। এই ঘটনায় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলিতে বাঙালি শ্রমিকদের উপর হয়রানি ও বৈষম্যমূলক আচরণের তীব্র নিন্দা করেছেন। তৃণমূল কংগ্রেসের হস্তক্ষেপ এবং আইনি পদক্ষেপের মাধ্যমে এই শ্রমিকদের মুক্তি নিশ্চিত করা হয়েছে। মমতা এই ঘটনাকে “বাংলা ভাষার উপর সন্ত্রাস” হিসেবে অভিহিত করে কেন্দ্রীয় সরকারের নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছেন।
গত ১৫ জুলাই থেকে হরিয়ানার গুরুগ্রাম এবং ফরিদাবাদে পশ্চিমবঙ্গের মালদহ, নদিয়া, মুর্শিদাবাদ, এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনার প্রায় ৩০ জন পরিযায়ী শ্রমিককে বাংলাদেশি সন্দেহে আটক করা হয়। এই শ্রমিকদের মধ্যে অনেকেই নির্মাণ শ্রমিক, নিরাপত্তারক্ষী, এবং পুরনো কাগজ সংগ্রহকারী হিসেবে কাজ করেন। অভিযোগ, শুধুমাত্র বাংলা ভাষায় কথা বলার কারণে তাদেরকে সন্দেহভাজন হিসেবে চিহ্নিত করে পুলিশ আটক করে। আটক শ্রমিকদের মধ্যে ছিলেন মালদহের চাঁচল ২ ব্লকের সায়েদ আলী এবং লালটু হোসেন, যারা আধার কার্ড এবং ভোটার কার্ড সত্ত্বেও পুলিশি হয়রানির শিকার হন।
তৃণমূল কংগ্রেসের রাজ্যসভার সাংসদ সামিরুল ইসলাম এই ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে হরিয়ানা সরকারের কাছে শ্রমিকদের মুক্তির দাবি জানান। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মুখ্যসচিব মনোজ পন্থকে আটক শ্রমিকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে আইনি সহায়তা প্রদানের নির্দেশ দেন মমতা। শনিবার (২৫ জুলাই) রাতের মধ্যে এই শ্রমিকদের মুক্তি নিশ্চিত করা হয়। মুক্ত শ্রমিকদের মধ্যে একজন, আনাজ শেখ, জানান, “আমরা আধার কার্ড দেখিয়েছি, তবুও পুলিশ আমাদের বাংলাদেশি বলে আটক করেছিল। তৃণমূলের সাহায্যে আমরা মুক্তি পেয়েছি।”
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতিক্রিয়া
২১ জুলাই কলকাতায় শহিদ দিবস সমাবেশে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই ঘটনার তীব্র সমালোচনা করেন। তিনি বলেন,
“বাংলা ভাষায় কথা বললেই কেন বাংলাদেশি বলে সন্দেহ করা হবে? এটি বাঙালি পরিচয়ের উপর আক্রমণ। বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলিতে বাঙালিদের উপর অত্যাচার চলছে।”
তিনি অভিযোগ করেন, কেন্দ্রীয় সরকারের একটি সার্কুলারে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে, সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে ৩০ দিন পর্যন্ত আটক রাখা যাবে, যা তিনি “বেআইনি এবং সংবিধানবিরোধী” বলে অভিহিত করেন।
মমতা আরও বলেন, “আমরা হাজার হাজার বাঙালিকে এই হয়রানি থেকে মুক্ত করেছি। দিল্লি, ওড়িশা, রাজস্থান, এবং হরিয়ানায় বাঙালিদের শুধু ভাষার কারণে আটক করা হচ্ছে। প্রয়োজনে আমরা ভাষা আন্দোলন শুরু করব।” তিনি বিজেপির বিরুদ্ধে ভোটার তালিকা থেকে বাঙালি নাম বাদ দেওয়ার ষড়যন্ত্রের অভিযোগও তুলেছেন।
এই ঘটনা পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী পশ্চিমবঙ্গে অবৈধ বাংলাদেশি অনুপ্রবেশের অভিযোগ তুলে বলেন, “মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সীমান্তে বেড়া নির্মাণে বাধা দিচ্ছেন, যার ফলে অবৈধ অনুপ্রবেশ বাড়ছে।” তিনি দাবি করেন, পশ্চিমবঙ্গে ১৭ লাখ রোহিঙ্গা রয়েছে, যা মমতা খণ্ডন করে বলেন, “বিশ্বে মোট রোহিঙ্গার সংখ্যা ১০ লাখ। শুভেন্দুবাবু পড়াশোনা করে কথা বলুন।”
তৃণমূলের সাংসদ সামিরুল ইসলাম এক্স-এ পোস্ট করে বলেন, “বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলিতে বাঙালিদের শুধু ভাষার কারণে হয়রানি করা হচ্ছে। বীরভূমের সোনালি খাতুনের মতো আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা নারীকেও বাংলাদেশি বলে আটক করা হয়েছে। এটি অমানবিক।” বিজেপির কিসান মোর্চার রাজ্য সভাপতি মহাদেব সরকার পাল্টা অভিযোগ করে বলেন, “তৃণমূল সরকার অবৈধ বাংলাদেশিদের আশ্রয় দিচ্ছে, যার ফলে সাধারণ বাঙালিরা হয়রানির শিকার হচ্ছেন।”
শ্রমিকদের অভিযোগ ও সরকারি পদক্ষেপ
মুক্ত শ্রমিকদের মধ্যে একজন, ফরিদাবাদের শুকুর আলি শেখ, জানান, “পুলিশ আমাদের বাংলাদেশি বলে স্বীকারোক্তি দিতে চাপ দিয়েছে। আমরা ভারতীয় নাগরিক, তবুও আমাদের মারধর করা হয়েছে।” তিনি আরও বলেন, “আটকদের মধ্যে হিন্দু শ্রমিকদের তাড়াতাড়ি ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, কিন্তু মুসলিম শ্রমিকদের বেশি হয়রানি করা হয়েছে।”
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, “আমরা শ্রমিকদের পাশে আছি। কোনো বাঙালিকে অন্যায়ভাবে হয়রানি করতে দেব না।” তিনি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর কাছে এই বিষয়ে হস্তক্ষেপের দাবি জানিয়েছেন এবং আইনি লড়াই চালিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
সমাজে প্রভাব ও ভাষা আন্দোলনের ডাক
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই ঘটনাকে বাঙালি পরিচয় ও ভাষার উপর আক্রমণ হিসেবে দেখছেন। তিনি বলেন, “আমরা সব ভাষাকে সম্মান করি, কিন্তু বাংলার উপর কেন অত্যাচার? প্রয়োজনে আমরা ভাষা আন্দোলন শুরু করব, যা ২০২৬ বিধানসভা নির্বাচন পর্যন্ত চলবে।” এই ঘোষণা পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক মহলে নতুন উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে।
বিশ্লেষকদের মতে, এই ঘটনা তৃণমূল কংগ্রেসকে বাঙালি অস্মিতার প্রশ্নকে কেন্দ্র করে নির্বাচনী প্রচারে শক্তি জোগাতে পারে। তবে, বিজেপির পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে, অবৈধ অনুপ্রবেশ নিয়ন্ত্রণের জন্য এই ধরনের পরিচয় যাচাই অপরিহার্য। এই বিতর্ক আগামী দিনে আরও জটিল রূপ নিতে পারে।

