২২ আগস্ট ২০২৫: প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী উদ্বোধন করবেন নতুন মেট্রো লাইন, অন্যান্য লাইনের সর্বশেষ অবস্থা
কলকাতা, ২০ আগস্ট ২০২৫: কলকাতা মেট্রোর ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় যুক্ত হতে চলেছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ২২ আগস্ট ২০২৫-এ কলকাতায় এসে তিনটি নতুন মেট্রো লাইনের উদ্বোধন করবেন, যার মধ্যে রয়েছে হাওড়া থেকে শিয়ালদহ পর্যন্ত গ্রিন লাইনের সংযোগ। এই রুটে মাত্র ১১ মিনিটে ভ্রমণ সম্ভব হবে, যা ভারতের দুটি ব্যস্ততম রেলওয়ে টার্মিনাস—হাওড়া এবং শিয়ালদহ—কে সংযুক্ত করবে। এই নতুন সংযোগ কলকাতার শহুরে যাতায়াতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে, লক্ষ লক্ষ যাত্রীর সময় এবং অর্থ সাশ্রয় করবে। কলকাতা মেট্রো রেল কর্পোরেশন লিমিটেড (কেএমআরসিএল) জানিয়েছে, এই রুটগুলো বাণিজ্যিকভাবে ২২ আগস্ট থেকে চালু হবে।
প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধন: কলকাতার জন্য ‘পুজোর উপহার’
কলকাতা মেট্রোর গ্রিন লাইন, যা ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রো নামেও পরিচিত, হাওড়া এবং শিয়ালদহ স্টেশনকে সংযুক্ত করছে। এই রুটে ভ্রমণের সময় মাত্র ১১ মিনিট, যা সড়কপথে ট্রাফিকের কারণে ৯০ মিনিটের যাত্রাকে বদলে দেবে। এই সংযোগটি গ্রিন লাইনের শেষ গ্যাপ—এসপ্ল্যানেড থেকে শিয়ালদহ (২.৬ কিলোমিটার)—পূরণের মাধ্যমে সম্পূর্ণ হয়েছে। এই অংশটি ২২ আগস্ট ২০২৫-এ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী উদ্বোধন করবেন।
রুটের বিবরণ: গ্রিন লাইনের এই সংযোগটি হাওড়া ময়দান থেকে সল্টলেক সেক্টর ফাইভ পর্যন্ত ১৬.৬ কিলোমিটার বিস্তৃত। এটি ১৭টি স্টেশন নিয়ে গঠিত, যার মধ্যে ১১টি উঁচু (এলিভেটেড) এবং ৬টি ভূগর্ভস্থ। হাওড়া থেকে শিয়ালদহ যাওয়ার পথে মোট ৪টি স্টেশন রয়েছে: হাওড়া ময়দান, হাওড়া, মহাকরণ এবং এসপ্ল্যানেড।
ভাড়া ও সময়: হাওড়া থেকে শিয়ালদহের ভাড়া ১০ টাকা। ট্রেনগুলি সকাল ৬:৫৫ থেকে রাত ১০:০০ পর্যন্ত ১২-১৫ মিনিটের ব্যবধানে চলবে। সপ্তাহে ৬ দিন (রবিবার বাদে) ১৩০টি পরিষেবা (৬৫টি পূর্বমুখী এবং ৬৫টি পশ্চিমমুখী) চলবে।
বৈশিষ্ট্য: এই রুটে ভারতের প্রথম এবং বৃহত্তম আন্ডারওয়াটার মেট্রো টানেল রয়েছে, যা হুগলি নদীর নীচ দিয়ে যায়। হাওড়া মেট্রো স্টেশনটি ভারতের গভীরতম মেট্রো স্টেশন, ৩৩ মিটার গভীরে অবস্থিত। এছাড়া, কমিউনিকেশনস বেসড ট্রেন কন্ট্রোল (সিবিটিসি) সিগন্যালিং সিস্টেম ব্যবহার করা হয়েছে, যা ট্রেনের স্বয়ংক্রিয় অপারেশন এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করে।
এই সংযোগ লক্ষ লক্ষ যাত্রীদের জন্য সুবিধাজনক, বিশেষ করে যারা শতাব্দী এবং বন্দে ভারত এক্সপ্রেসের মতো দূরপাল্লার ট্রেন থেকে নেমে রানাঘাট, বনগাঁ, নিউ গড়িয়া, দমদম এবং সল্টলেকে যেতে চান।
শুরুর সময় ও চ্যালেঞ্জ
গ্রিন লাইনের হাওড়া-শিয়ালদহ সংযোগটি বেশ কয়েকটি চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে এগিয়েছে। ১৯৭১ সালে এই রুটের মাস্টার প্ল্যান তৈরি হয়েছিল, কিন্তু ২০০৪ সালে দিল্লি মেট্রোর সাফল্যের পর এটি বাস্তবায়নের জন্য তোড়জোড় শুরু হয়। ২০০৯ সালে কেএমআরসিএল গঠনের মাধ্যমে নির্মাণ শুরু হয়। বাউবাজার এলাকায় টানেল নির্মাণের সময় মাটির ধস এবং জলের ফুটোর সমস্যার কারণে এসপ্ল্যানেড-শিয়ালদহ অংশের কাজ বিলম্বিত হয়। তবে, ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে ট্র্যাক স্থাপন সম্পন্ন হয়, এবং ২১ জানুয়ারি ২০২৫-এ প্রথম ট্রায়াল রান সফলভাবে সম্পন্ন হয়।
গ্রিন লাইনের প্রথম পর্যায় (সল্টলেক সেক্টর ফাইভ থেকে সল্টলেক স্টেডিয়াম) ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০-এ চালু হয়। এরপর ফুলবাগান পর্যন্ত ৪ অক্টোবর ২০২০-এ এবং শিয়ালদহ পর্যন্ত ১৪ জুলাই ২০২২-এ চালু হয়। হাওড়া ময়দান থেকে এসপ্ল্যানেড অংশটি ৬ মার্চ ২০২৪-এ উদ্বোধন করা হয়। এসপ্ল্যানেড-শিয়ালদহ অংশটি এখন পূর্ণাঙ্গ রুটটিকে একীভূত করেছে।

অন্যান্য মেট্রো লাইনের অবস্থা
কলকাতা মেট্রো বর্তমানে ৩টি লাইন পরিচালনা করছে, এবং আরও ৩টি লাইন নির্মাণাধীন বা পরিকল্পনাধীন। এখানে সর্বশেষ অবস্থা:
ব্লু লাইন (দক্ষিণেশ্বর-কবি সুভাষ): এটি কলকাতার প্রথম মেট্রো লাইন, যা ১৯৮৪ সালে চালু হয়। এটি সম্পূর্ণ চালু এবং প্রতিদিন ৫ লক্ষেরও বেশি যাত্রী বহন করে। ভাড়া ৫-২৫ টাকা। এই লাইনে এসপ্ল্যানেডে গ্রিন লাইনের সঙ্গে ইন্টারচেঞ্জ রয়েছে।
পার্পল লাইন (জোকা-এসপ্ল্যানেড): এই লাইনের জোকা থেকে তরতলা অংশ ২ জানুয়ারি ২০২৩ থেকে চালু। মাঝেরহাট থেকে এসপ্ল্যানেড অংশ নির্মাণাধীন এবং ২০২৬ সালের মধ্যে চালু হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এই লাইনের ফুটফল প্রতিদিন ৫,০০০।
ইয়েলো লাইন (নোয়াপাড়া-জয় হিন্দ/এয়ারপোর্ট): নোয়াপাড়া স্টেশন বর্তমানে চালু। দমদম ক্যান্টনমেন্ট থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত অংশ নির্মাণাধীন এবং ২২ আগস্ট ২০২৫-এ উদ্বোধন হবে। এই লাইনটি কলকাতা বিমানবন্দরের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করবে।
অরেঞ্জ লাইন (নিউ গড়িয়া-রুবি): রুবি থেকে মেট্রোপলিটান অংশ ২২ আগস্ট ২০২৫-এ চালু হবে। এই লাইনটি কবি সুভাষ থেকে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় পর্যন্ত বিস্তৃত হবে।
গ্রিন লাইনের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা: সেক্টর ফাইভ থেকে তেঘরিয়া পর্যন্ত সম্প্রসারণ পরিকল্পনাধীন, যা ২০৩৫ সালের মধ্যে সম্পন্ন হবে। এটি ২৩.১ কিলোমিটার দীর্ঘ হবে এবং প্রতিদিন ১০ লক্ষ যাত্রী বহন করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
এয়ারপোর্ট লাইন: সল্টলেক সেক্টর ফাইভ থেকে কলকাতা বিমানবন্দর পর্যন্ত একটি নতুন লাইন পরিকল্পনাধীন।
প্রভাব ও সুবিধা
হাওড়া-শিয়ালদহ মেট্রো সংযোগ কলকাতার যাতায়াত ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনবে। এর প্রধান সুবিধাগুলো হল:
সময় সাশ্রয়: ৯০ মিনিটের যাত্রা ১১ মিনিটে নেমে এসেছে, যা ব্যবসায়ী, ছাত্র এবং দৈনন্দিন যাত্রীদের জন্য বড় সুবিধা।
ট্রাফিক হ্রাস: সড়কপথে যানজট কমবে, যা শহরের বায়ু দূষণ কমাতে সাহায্য করবে।
নিরাপত্তা: প্ল্যাটফর্ম স্ক্রিন ডোর এবং সিবিটিসি সিগন্যালিং সিস্টেম যাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে।
অর্থনৈতিক উন্নয়ন: হাওড়া এবং সল্টলেকের মতো বাণিজ্যিক কেন্দ্রগুলোর সংযোগ ব্যবসা ও অর্থনীতিকে উৎসাহিত করবে।
কেএমআরসিএল-এর মতে, গ্রিন লাইন প্রতিদিন ১ লক্ষেরও বেশি যাত্রী বহন করছে, এবং সম্পূর্ণ রুট চালু হলে এই সংখ্যা ১০ লক্ষে পৌঁছাবে।
কলকাতা মেট্রোর গ্রিন লাইনের হাওড়া-শিয়ালদহ সংযোগ শহরের যাতায়াত ব্যবস্থায় এক নতুন যুগের সূচনা করছে। মাত্র ১১ মিনিটে এই দুটি ব্যস্ত রেলওয়ে হাব সংযুক্ত করা কলকাতার শহুরে জীবনকে আরও সহজ এবং দক্ষ করে তুলবে। অন্যান্য মেট্রো লাইনের সম্প্রসারণের সঙ্গে কলকাতা একটি আধুনিক এবং সংযুক্ত শহরে পরিণত হচ্ছে। যাত্রীদের জন্য পরামর্শ: ভাড়া এবং সময়সূচি চেক করুন এবং এই নতুন সংযোগের সুবিধা উপভোগ করুন।

