নিবিড় সমীক্ষা কী?
ভোটার তালিকার নিবিড় সমীক্ষা বা স্পেশাল ইনটেনসিভ রিভিশন (SIR) হল নির্বাচন কমিশনের একটি বিশেষ প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে ভোটার তালিকার নির্ভুলতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা হয়। এই প্রক্রিয়ায় বুথ লেভেল অফিসাররা (BLO) বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটারদের তথ্য যাচাই করে, যেমন নাম, ঠিকানা, বয়স, এবং নাগরিকত্ব সম্পর্কিত নথি। এর উদ্দেশ্য হল মৃত বা অনুপস্থিত ভোটারদের নাম বাদ দেওয়া, একাধিক নাম সংশোধন করা, এবং অবৈধ বা ভুয়ো ভোটারদের চিহ্নিত করা। ভারতের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২১ অনুযায়ী, নির্বাচন কমিশনের এই ক্ষমতা রয়েছে, যা ভোটের পবিত্রতা রক্ষার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
প্রয়োজনীয় নথির তালিকা:
নির্বাচন কমিশন কর্তৃক ২৪ জুন ২০২৫-এ জারি করা আদেশ অনুযায়ী, নিম্নলিখিত ১১টি নথির মধ্যে যেকোনো একটি গ্রহণযোগ্য:timesofindia.indiatimes.com
- জন্ম শংসাপত্র (Birth Certificate)
- পাসপোর্ট (Indian Passport)
- ম্যাট্রিকুলেশন/শিক্ষা সনদ (Matriculation Certificate বা অন্যান্য শিক্ষা সংক্রান্ত সনদ যা জন্ম তারিখ উল্লেখ করে)
- সরকারি কর্মচারী/পেনশনভোগীদের জন্য পেনশন পেমেন্ট অর্ডার (Pension Payment Order issued to government employees/pensioners)
- স্থায়ী বাসিন্দা শংসাপত্র (Permanent Residence Certificate issued by competent State authority)
- জাতি সনদ (SC/ST Certificate)
- ফরেস্ট রাইট শংসাপত্র (Forest Right Certificate)
- স্থানীয় কর্তৃপক্ষ, ব্যাঙ্ক বা পোস্ট অফিস কর্তৃক জারি করা সনদ (Certificate issued by local authorities, banks, or post offices prior to July 1, 1987)
- জাতীয় নাগরিক পঞ্জি (NRC) (যেখানে এটি বিদ্যমান, যেমন আসামে)
- পারিবারিক রেজিস্টার (Family Register issued by state or local authorities)
- সরকার কর্তৃক জারি করা জমি বা বাড়ির বরাদ্দ সনদ (Land or house allotment certificate issued by the government)
গুরুত্বপূর্ণ তথ্য:
- আধার, ভোটার আইডি, রেশন কার্ড, প্যান কার্ড, বা ড্রাইভিং লাইসেন্স গ্রহণযোগ্য নয়: এই নথিগুলি নাগরিকত্ব বা জন্মস্থানের প্রমাণ হিসেবে গণ্য হয় না, যদিও এগুলি নতুন ভোটার নিবন্ধনের জন্য ফর্ম ৬-এ ব্যবহার করা যায়।indiatoday.inthehindu.com
- ২০০৩ সালের তালিকাভুক্ত ভোটারদের জন্য: যারা ২০০৩ সালের SIR-এ তালিকাভুক্ত ছিলেন (বিহারে প্রায় ৪.৯৬ কোটি ভোটার), তাদের শুধুমাত্র সেই তালিকার একটি নির্যাস জমা দিয়ে এনুমারেশন ফর্ম পূরণ করতে হবে।ndtv.comtimesofindia.indiatimes.com
- নথি ছাড়া জমা দেওয়ার সুযোগ: নির্বাচন কমিশন ৬ জুলাই ২০২৫-এ ঘোষণা করেছে যে, যদি কারও কাছে এই নথি না থাকে, তবে শুধুমাত্র পূরণকৃত এনুমারেশন ফর্ম জমা দেওয়া যাবে। এই ক্ষেত্রে, ইলেকটোরাল রেজিস্ট্রেশন অফিসার (ERO) স্থানীয় তদন্ত বা অন্যান্য নথির ভিত্তিতে যাচাই করবেন।thehindu.comndtv.com
- স্ব-প্রত্যয়িত ঘোষণা: নতুন ভোটার বা ২০০৩-এর পরে তালিকাভুক্ত ভোটারদের ভারতীয় নাগরিকত্বের একটি স্ব-প্রত্যয়িত ঘোষণা জমা দিতে হবে।indiatoday.in
- এনুমারেশন ফর্ম: বুথ লেভেল অফিসার (BLO) বাড়ি বাড়ি গিয়ে এই ফর্ম বিতরণ করেন এবং সংগ্রহ করেন। ফর্মটি ২৫ জুন থেকে ২৬ জুলাই ২০২৫-এর মধ্যে জমা দিতে হবে। এরপর দাবি ও আপত্তির সময়কাল ১ আগস্ট থেকে ১ সেপ্টেম্বর ২০২৫ পর্যন্ত চলবে, এবং চূড়ান্ত তালিকা ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫-এ প্রকাশিত হবে।timesofindia.indiatimes.comtimesofindia.indiatimes.com
পশ্চিমবঙ্গে পরিস্থিতি:
পশ্চিমবঙ্গে এখনও SIR শুরু হয়নি, তবে আগস্ট ২০২৫ থেকে এই প্রক্রিয়া শুরু হতে পারে বলে জানা গেছে। বাংলায় ২০০২ সালে শেষবার নিবিড় সমীক্ষা হয়েছিল, এবং এবারও একই ধরনের নথির প্রয়োজন হতে পারে। তবে, যারা ২০০২ সালের তালিকায় রয়েছেন, তাদের নতুন করে নথি জমা দেওয়ার প্রয়োজন হবে না।
সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ:
সুপ্রিম কোর্ট ১০ জুলাই ২০২৫-এ নির্বাচন কমিশনকে আধার, ভোটার আইডি, এবং রেশন কার্ডকে SIR-এর জন্য গ্রহণযোগ্য নথি হিসেবে বিবেচনা করার পরামর্শ দিয়েছে। তবে, কমিশন তাদের শপথপত্রে জানিয়েছে যে এই নথিগুলি এককভাবে নাগরিকত্বের প্রমাণ হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয়, কারণ এগুলি জন্মস্থান বা নাগরিকত্ব নির্দেশ করে না। ২৮ জুলাই ২০২৫-এ সুপ্রিম কোর্টে এই বিষয়ে পরবর্তী শুনানি হবে, যেখানে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হতে পারে।timesofindia.indiatimes.comndtv.com
পরামর্শ:
- নথি প্রস্তুত রাখুন: উপরোক্ত নথিগুলির মধ্যে যেকোনো একটি প্রস্তুত রাখুন। যদি এই নথি না থাকে, তবে এনুমারেশন ফর্ম পূরণ করে BLO-এর কাছে জমা দিন।
- BLO-এর সঙ্গে যোগাযোগ: আপনার এলাকার বুথ লেভেল অফিসারের সঙ্গে যোগাযোগ করুন এবং ফর্ম পূরণে সহায়তা নিন।
- সচেতন থাকুন: নির্বাচন কমিশনের অফিসিয়াল ওয়েবসাইট (voters.eci.gov.in) বা স্থানীয় নির্বাচন অফিসে খোঁজ নিয়ে সর্বশেষ তথ্য জানুন।
- দাবি ও আপত্তি: যদি আপনার নাম ভুলবশত বাদ পড়ে, তবে ১ আগস্ট থেকে ১ সেপ্টেম্বর ২০২৫-এর মধ্যে দাবি ও আপত্তি জানানোর সুযোগ থাকবে।
বিহারে ভোটার কার্ড সমস্যা: কী ঘটছে?
বিহারে আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনের আগে নির্বাচন কমিশন নিবিড় সমীক্ষা শুরু করেছে, যার ফলে প্রায় ৫৬ লক্ষ ভোটারের নাম তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। এই প্রক্রিয়ায় নাগরিকত্ব যাচাইয়ের জন্য কঠোর নথি, যেমন জন্ম সনদ, পাসপোর্ট, বা অন্যান্য সরকারি পরিচয়পত্রের প্রয়োজন হয়েছে। নির্বাচন কমিশন দাবি করেছে, এই পদক্ষেপের মাধ্যমে বাংলাদেশ, নেপাল, এবং মিয়ানমারের অবৈধ অভিবাসীদের নাম তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হচ্ছে। তবে, বিরোধী দলগুলি এই প্রক্রিয়াকে ‘ঘুরপথে এনআরসি’ বলে অভিযোগ তুলেছে।
বিহারে এই সমীক্ষার ফলে অনেক বৈধ ভোটারও তাদের নাম তালিকা থেকে বাদ পড়ার ভয়ে আতঙ্কিত। রাষ্ট্রীয় জনতা দলের (RJD) নেতা তেজস্বী যাদব এই প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেছেন, “কমিশনের তথ্য সংগ্রহের প্রক্রিয়া অগোছালো। ফর্ম ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে, এমনকি কোথাও জিলিপি বিক্রির কাজেও ব্যবহৃত হচ্ছে।” এই ঘটনা বিহারের রাজনীতিকে উত্তপ্ত করে তুলেছে।
পশ্চিমবঙ্গে নিবিড় সমীক্ষা নিয়ে উদ্বেগ
পশ্চিমবঙ্গে ২০২৬ সালে বিধানসভা নির্বাচনের আগে নির্বাচন কমিশন ভোটার তালিকা সংশোধনের পরিকল্পনা করছে। এই খবরে রাজ্যের মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়েছে, বিশেষ করে বিহারের ঘটনার পর। অনেকে আশঙ্কা করছেন যে, তাদের নাম ভোটার তালিকা থেকে বাদ পড়তে পারে, যা তাদের ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করবে।
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী কী বলেছেন?
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই নিবিড় সমীক্ষার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছেন। তিনি দাবি করেছেন, “নির্বাচন কমিশন বিজেপির ইশারায় কাজ করছে এবং এই প্রক্রিয়া ঘুরপথে জাতীয় নাগরিক পঞ্জি (NRC) চালু করার চেষ্টা।” তিনি আরও বলেছেন, “বিহারে যেভাবে ভোটারদের নাম কাটা হচ্ছে, তা বাংলায় হলে তৃণমূল কংগ্রেস রাস্তায় নামবে এবং কমিশনকে ঘেরাও করবে।” মমতা অভিযোগ করেছেন যে, বিজেপি নির্বাচনে সুবিধা পাওয়ার জন্য বেছে বেছে বিরোধী শিবিরের ভোটারদের নাম বাদ দিচ্ছে।

রাজনৈতিক দলগুলো কী বলছে?
- তৃণমূল কংগ্রেস (TMC): তৃণমূল নেতা জয়প্রকাশ মজুমদার বলেছেন, “নির্বাচন কমিশন বিজেপির কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। এই প্রক্রিয়া ভোটের অধিকার কেড়ে নেওয়ার ষড়যন্ত্র।” মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম বলেছেন, “বিজেপিকে জেতানোর জন্য দেখে দেখে ভোটারদের নাম বাদ দেওয়া হচ্ছে।”
- ভারতীয় জনতা পার্টি (BJP): বিজেপি এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে বলেছে, “কেবল বিহারের বৈধ ভোটাররাই ভোট দেবেন, অবৈধ অভিবাসীরা নয়।” বিজেপির মুখপাত্র শাহনাওয়াজ হুসেইন বলেছেন, “ভোটার তালিকা সংশোধন বৈধ ভোটারদের কোনও সমস্যা সৃষ্টি করছে না। এটি শুধু অবৈধ নাম বাদ দেওয়ার জন্য।”
- বাম ও কংগ্রেস: সিপিআইএম নেতা মহম্মদ সেলিম এই বিষয়ে কটাক্ষ করে বলেছেন, “মমতা নিজেই ভূতের ভয় দেখাচ্ছেন, অথচ তিনি নিজেই ভূত তাড়ানোর কথা বলছেন।” বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী বলেছেন, “মমতার অভিযোগের কোনও তথ্যপ্রমাণ নেই। তিনি নির্বাচন কমিশনের কাছে প্রমাণ দিক।”
নির্বাচন কমিশনের বক্তব্য
নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, তাদের লক্ষ্য শুধু ভোটার তালিকার পবিত্রতা রক্ষা করা। তারা সুপ্রিম কোর্টে জানিয়েছে, আধার, ভোটার কার্ড, বা রেশন কার্ডকে নাগরিকত্বের প্রমাণ হিসেবে গণ্য করা হবে না, তবে নাগরিকত্ব যাচাইয়ের অধিকার তাদের রয়েছে। কমিশনের দাবি, এই প্রক্রিয়ায় কারও নাগরিকত্ব বাতিল হবে না, শুধু ভোটার তালিকার সঠিকতা নিশ্চিত করা হবে। তবে, সুপ্রিম কোর্টে এই প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, এবং ২৮ জুলাই এই বিষয়ে পরবর্তী শুনানি হবে।
পশ্চিমবঙ্গে মানুষের ভয়: বর্তমান পরিস্থিতি
বিহারের ঘটনার পর পশ্চিমবঙ্গে মানুষের মধ্যে ভয় ছড়িয়েছে যে, তাদের নামও ভোটার তালিকা থেকে বাদ পড়তে পারে। বিশেষ করে, সীমান্তবর্তী এলাকার বাসিন্দারা এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ আতঙ্কিত। অনেকে মনে করছেন, এই প্রক্রিয়া এনআরসি-র পূর্বাভাস। ২০০২ সালে বাংলায় শেষ নিবিড় সমীক্ষা হয়েছিল, এবং এবারও এই প্রক্রিয়া শুরু হলে লক্ষ লক্ষ মানুষের ভোটাধিকার হারানোর আশঙ্কা রয়েছে।
নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, অগাস্ট থেকে বাংলায় ভোটার তালিকা যাচাই শুরু হতে পারে। এই প্রক্রিয়ায় নথি হিসেবে জাতীয় পরিচয়পত্র, জন্ম সনদ, বা অন্যান্য সরকারি নথির প্রয়োজন হবে। তবে, যারা ২০০২ সালের সমীক্ষায় তালিকাভুক্ত ছিলেন, তাদের নতুন করে নথি জমা দেওয়ার প্রয়োজন নেই।
ভোটার তালিকার নিবিড় সমীক্ষা নিয়ে বিহার থেকে বাংলা, রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে তীব্র বিতর্ক চলছে। নির্বাচন কমিশন যেখানে এটিকে একটি সাংবিধানিক দায়িত্ব বলছে, সেখানে বিরোধীরা এটিকে বিজেপির রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডা হিসেবে দেখছে। পশ্চিমবঙ্গে এই প্রক্রিয়া শুরু হলে রাজনৈতিক উত্তেজনা আরও বাড়বে বলে মনে করা হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে, সাধারণ মানুষের মধ্যে ভয় ও অনিশ্চয়তা কাটিয়ে উঠতে নির্বাচন কমিশনের স্বচ্ছ এবং নিরপেক্ষ পদক্ষেপ অত্যন্ত জরুরি।


https://bengalinewstoday.in/2025/07/25/voter-list-intensive-revision-2025-bihar-bengal-politics-documents/