৩১ জুলাই ২০২৫: ভারত-মার্কিন বাণিজ্য সম্পর্কে নতুন টানাপোড়েন
৩০ জুলাই ২০২৫, বুধবার, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ভারতীয় আমদানির উপর ২৫% শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছেন, যা ১ আগস্ট ২০২৫ থেকে কার্যকর হবে। এছাড়া, ভারতের রাশিয়া থেকে তেল ও অস্ত্র ক্রয়ের জন্য অতিরিক্ত “শাস্তিমূলক শুল্ক” আরোপের হুমকি দিয়েছেন তিনি। এই ঘোষণার পরপরই, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরানের সঙ্গে তেল বাণিজ্যের অভিযোগে ছয়টি ভারতীয় কোম্পানির উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। ভারত সরকার এই পদক্ষেপের প্রভাব পর্যালোচনা করছে এবং জাতীয় স্বার্থ রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এই নিবন্ধে আমরা ট্রাম্পের শুল্ক নীতি, ভারতীয় কোম্পানির উপর নিষেধাজ্ঞা, ভারতের প্রতিক্রিয়া এবং এর সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।
ট্রাম্পের শুল্ক ঘোষণা: পটভূমি ও কারণ
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দীর্ঘদিন ধরে ভারতের উচ্চ শুল্ক এবং অ-শুল্ক বাণিজ্য বাধার সমালোচনা করে আসছেন। তিনি ভারতকে “শুল্কের রাজা” এবং “বাণিজ্য সম্পর্কের অপব্যবহারকারী” হিসেবে অভিহিত করেছেন। ট্রাম্পের মতে, ভারতের গড় শুল্ক হার ১২%, যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গড় শুল্ক হার মাত্র ২.২%। এছাড়া, ভারতের ডিজিটাল পরিষেবার উপর কর এবং কৃষি ও দুগ্ধ খাতে সুরক্ষাবাদী নীতি মার্কিন পণ্যের বাজারে প্রবেশে বাধা সৃষ্টি করছে।
৩০ জুলাইয়ের ঘোষণায় ট্রাম্প বলেন, “ভারত আমাদের বন্ধু হলেও, তাদের শুল্ক হার বিশ্বের মধ্যে সর্বোচ্চ এবং তাদের অ-শুল্ক বাণিজ্য বাধা যেকোনো দেশের তুলনায় কঠোর ও অগ্রহণযোগ্য।” তিনি আরও উল্লেখ করেন যে ভারত রাশিয়ার কাছ থেকে প্রচুর পরিমাণে তেল ও সামরিক সরঞ্জাম ক্রয় করে, যা ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে রাশিয়ার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞাকে দুর্বল করে। এই কারণে ভারতের উপর ২৫% শুল্ক এবং অতিরিক্ত শাস্তিমূলক শুল্ক আরোপের হুমকি দিয়েছেন তিনি।
ট্রাম্পের এই পদক্ষেপ ভারত-মার্কিন বাণিজ্য সম্পর্কে নতুন উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে। ২০২৪ সালে ভারতের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি ছিল প্রায় ৮৭ বিলিয়ন ডলার, যা ভারতের সবচেয়ে বড় রপ্তানি বাজার। এই শুল্ক আরোপের ফলে ভারতের অটো পার্টস, ইস্পাত, অ্যালুমিনিয়াম, স্মার্টফোন, রত্ন ও গহনা, টেক্সটাইল এবং পোশাকের মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলো মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তবে, ফার্মাসিউটিক্যালস, সেমিকন্ডাক্টর এবং গুরুত্বপূর্ণ খনিজ খাত এই শুল্ক থেকে মুক্ত রাখা হয়েছে।
ভারতীয় কোম্পানির উপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা
ট্রাম্পের শুল্ক ঘোষণার একদিন পর, ৩১ জুলাই ২০২৫, মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর ইরানের সঙ্গে তেল ও পেট্রোকেমিক্যাল বাণিজ্যে জড়িত থাকার অভিযোগে ছয়টি ভারতীয় কোম্পানির উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এই কোম্পানিগুলো হলো: কাঞ্চন পলিমার্স, অ্যালকেমিক্যাল সলিউশনস, রমনীকলাল এস গোসালিয়া অ্যান্ড কোম্পানি, জুপিটার ডাই কেম, গ্লোবাল ইন্ডাস্ট্রিয়াল কেমিক্যালস এবং পার্সিস্টেন্ট পেট্রোকেম। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “এই কোম্পানিগুলোর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে থাকা সমস্ত সম্পত্তি এবং সম্পত্তির স্বার্থ বাজেয়াপ্ত করা হবে।”
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দাবি, এই কোম্পানিগুলো ইরানের তেল রপ্তানির মাধ্যমে তেহরানের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করছে, যা মার্কিন নিষেধাজ্ঞার লঙ্ঘন। এই পদক্ষেপ ভারত-ইরান সম্পর্ক এবং ভারতের শক্তি নিরাপত্তার উপর নতুন চাপ সৃষ্টি করেছে। উল্লেখ্য, ভারত ২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসে তার মোট তেল আমদানির ৩৫% রাশিয়া থেকে এবং উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ইরান থেকে আমদানি করেছে।
ভারত সরকারের প্রতিক্রিয়া
ভারত সরকার ট্রাম্পের শুল্ক ঘোষণা এবং নিষেধাজ্ঞার প্রতিক্রিয়ায় একটি সতর্ক অথচ দৃঢ় বিবৃতি জারি করেছে। সরকার বলেছে, “আমরা মার্কিন প্রেসিডেন্টের বাণিজ্য সংক্রান্ত বিবৃতির বিষয়ে নোট করেছি। সরকার এর প্রভাব পর্যালোচনা করছে। ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গত কয়েক মাস ধরে একটি ন্যায্য, ভারসাম্যপূর্ণ এবং পারস্পরিকভাবে উপকারী বাণিজ্য চুক্তির জন্য আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। আমরা এই লক্ষ্যে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।”
ভারতীয় বাণিজ্য মন্ত্রী পীযূষ গোয়াল বলেছেন, “কৃষি ও দুগ্ধ খাত ভারতের জন্য সংবেদনশীল। আমরা আমাদের কৃষক, উদ্যোক্তা এবং ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষা করব।” তিনি আরও জানিয়েছেন যে আগস্টের শেষে একটি মার্কিন প্রতিনিধি দল ভারত সফর করবে এবং শরৎকালের মধ্যে একটি বাণিজ্য চুক্তি চূড়ান্ত করার সম্ভাবনা রয়েছে।
ভারতীয় জনতা পার্টির সাংসদ অশোক চৌহান মার্কিন প্রেসিডেন্টের এই সিদ্ধান্তকে “একতরফা” বলে সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেন, “এই সিদ্ধান্ত পারস্পরিক আলোচনার ভিত্তিতে নেওয়া হয়নি। আমাদের বাণিজ্য মন্ত্রী মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন। আমাদের ক্ষতি এড়াতে আলোচনার সুযোগ কাজে লাগানো উচিত।”
সম্ভাব্য প্রভাব
ট্রাম্পের ২৫% শুল্ক এবং অতিরিক্ত শাস্তিমূলক শুল্ক ভারতের অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে পারে। অর্থনীতিবিদরা অনুমান করছেন, এই শুল্ক ২০২৬ সাল পর্যন্ত বহাল থাকলে ভারতের জিডিপি ০.২% থেকে ০.৫% কমতে পারে। মহারাষ্ট্র, গুজরাট, তামিলনাড়ু এবং কর্ণাটকের মতো রপ্তানি-নির্ভর রাজ্যের ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ (এমএসএমই) বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
ভারতীয় শেয়ার বাজার এবং রুপির মূল্যও এই ঘোষণার পর প্রভাবিত হয়েছে। ব্লুমবার্গের রিপোর্ট অনুযায়ী, ঘোষণার পর ভারতীয় রুপি অফশোর বাজারে পড়ে গেছে এবং ভারতীয় শেয়ার ফিউচারও হ্রাস পেয়েছে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বাণিজ্য চুক্তির অপেক্ষায় বাজারে নিষ্ক্রিয় রয়েছেন।
ইরানের সঙ্গে তেল বাণিজ্যে জড়িত ছয়টি ভারতীয় কোম্পানির উপর নিষেধাজ্ঞা ভারতের শক্তি নিরাপত্তার জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করেছে। ভারত রাশিয়া ও ইরান থেকে সাশ্রয়ী মূল্যে তেল আমদানি করে শক্তি খাতে স্থিতিশীলতা বজায় রাখে। এই নিষেধাজ্ঞা ভারতের তেল আমদানি ব্যয় বাড়াতে পারে, যা জ্বালানি এবং পেট্রোকেমিক্যাল পণ্যের দাম বৃদ্ধির কারণ হতে পারে।
ভারত-মার্কিন বাণিজ্য আলোচনা: বর্তমান অবস্থা
ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গত কয়েক মাস ধরে একটি বাণিজ্য চুক্তির জন্য আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। ২০২৪ সালে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ১৯১ বিলিয়ন ডলার, এবং উভয় দেশ ২০৩০ সালের মধ্যে এটি ৫০০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। তবে, কৃষি ও দুগ্ধ খাতে বাজার অ্যাক্সেস এবং শুল্ক হ্রাস নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতের কৃষি ও দুগ্ধ খাতে বৃহত্তর বাজার অ্যাক্সেস চায়, যেখানে ভারত তার কৃষক ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের সুরক্ষার জন্য সুরক্ষাবাদী নীতি বজায় রাখতে চায়। ভারতীয় বাণিজ্য নীতি দীর্ঘদিন ধরে সুরক্ষাবাদী, এবং এই নীতি ভারতের খাদ্য নিরাপত্তা ও কৃষকদের জীবিকার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ফরেন ট্রেডের ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর জোশি ট্রাম্পের শুল্ক হুমকিকে “হাত মুচড়ানোর কৌশল” বলে সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেন, “ভারত-যুক্তরাজ্য বাণিজ্য চুক্তি একটি মানদণ্ড স্থাপন করেছে, যেখানে ৯০% ব্রিটিশ পণ্য ভারতে কম শুল্কে প্রবেশ করছে এবং ৯৯% ভারতীয় পণ্য যুক্তরাজ্যে কম শুল্কে প্রবেশ করছে। ভারত-মার্কিন চুক্তির ক্ষেত্রেও এমন ভারসাম্যপূর্ণ পদ্ধতি প্রয়োজন।”
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ট্রাম্পের শুল্ক ও নিষেধাজ্ঞা স্বল্পমেয়াদী হতে পারে, কারণ ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উভয়ই একটি বাণিজ্য চুক্তির জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এআই ইন্ডিয়ার ট্রেড পলিসি লিডার অগ্নেশ্বর সেন বলেন, “ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে শক্তিশালী কৌশলগত অংশীদারিত্বের প্রেক্ষিতে এই শুল্ক দুঃখজনক। তবে, আগস্টের শেষে মার্কিন প্রতিনিধি দলের ভারত সফর এবং শরৎকালের মধ্যে চুক্তির সম্ভাবনা ইতিবাচক।”
ভারতীয় রপ্তানিকারকদের এখন নতুন বাজারের দিকে মনোযোগ দিতে হবে এবং মার্কিন গ্রাহকদের ধরে রাখার জন্য দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। এফআইসিসিআই এই শুল্ক আরোপের নিন্দা করেছে এবং বলেছে, “এই পদক্ষেপ ভারত-মার্কিন সম্পর্কের জন্য ক্ষতিকর।”
ট্রাম্পের ২৫% শুল্ক ঘোষণা এবং ভারতীয় কোম্পানির উপর নিষেধাজ্ঞা ভারতের অর্থনীতি ও বৈদেশিক সম্পর্কের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করেছে। ভারত সরকার এই পরিস্থিতির প্রভাব পর্যালোচনা করছে এবং জাতীয় স্বার্থ রক্ষার জন্য দৃঢ় প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছে। আগামী মাসগুলোতে ভারত-মার্কিন বাণিজ্য আলোচনা এবং কূটনৈতিক প্রচেষ্টা এই উত্তেজনা কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
আপনি এই শুল্ক ও নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে কী মনে করেন? কমেন্টে আপনার মতামত শেয়ার করুন এবং সর্বশেষ আপডেটের জন্য আমাদের ওয়েবসাইট bengalinewstoday.in ভিজিট করুন।


Us এর ট্যারিফ নীতি ভারতে খুব বেশি প্রভাব পড়বে না।
https://bengalinewstoday.in/trump-tariffs-india-sanctions-2025-latest-news/