ভারতের গর্ব, আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে শুভাংশু শুক্লার ১৮ দিনের গবেষণা ও উৎসব
নয়াদিল্লি, ১৪ জুলাই ২০২৫: ভারতীয় বিমান বাহিনীর গ্রুপ ক্যাপ্টেন শুভাংশু শুক্লা, ভারতের প্রথম মহাকাশচারী হিসেবে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে (আইএসএস) পা রেখে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। অ্যাক্সিওম-৪ (Ax-4) মিশনের অংশ হিসেবে ১৮ দিনের একটি গুরুত্বপূর্ণ মিশন শেষ করে তিনি আজ, ১৪ জুলাই, বিকেল ৪:৩৫ মিনিটে (ভারতীয় সময়) আইএসএস থেকে পৃথিবীতে ফেরার যাত্রা শুরু করছেন। এই ঐতিহাসিক যাত্রা ভারতের মহাকাশ গবেষণার ক্ষেত্রে একটি নতুন মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।
গত ২৫ জুন ফ্লোরিডার নাসার কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে স্পেসএক্স ফ্যালকন-৯ রকেটে করে অ্যাক্সিওম-৪ মিশনের চার সদস্যের দল মহাকাশে যাত্রা করে। দলের নেতৃত্বে ছিলেন অভিজ্ঞ মার্কিন মহাকাশচারী পেগি হুইটসন, এবং শুভাংশু শুক্লা ছিলেন এই মিশনের পাইলট। পোল্যান্ডের স্লাওয়োজ উজনানস্কি-উইশনিয়েভস্কি এবং হাঙ্গেরির তিবোর কাপু ছিলেন মিশন স্পেশালিস্ট। ২৬ জুন মহাকাশযান আইএসএস-এর সঙ্গে সফলভাবে সংযুক্ত হয়, এবং শুভাংশু শুক্লা ভারতের দ্বিতীয় মহাকাশচারী হিসেবে (১৯৮৪ সালে রাকেশ শর্মার পর) এই স্টেশনে প্রবেশ করেন।
গবেষণার নতুন দিগন্ত
শুভাংশু শুক্লা এই ১৮ দিনে আইএসএস-এ ৬০টিরও বেশি বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন। তাঁর গবেষণার মধ্যে ছিল মাইক্রোঅ্যালজি পরীক্ষা, যা ভবিষ্যতের দীর্ঘমেয়াদী মহাকাশ অভিযানে খাদ্য, অক্সিজেন এবং জৈব জ্বালানি সরবরাহের সম্ভাবনা নিয়ে কাজ করছে। এছাড়াও, তিনি মেথি ও মুগ ডালের স্প্রাউট চাষের পরীক্ষা করেছেন, যা মহাকাশে খাদ্য উৎপাদনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সরবরাহ করবে। এই পরীক্ষাগুলো ভারতের গগনযান মিশনের জন্য মূল্যবান তথ্য প্রদান করবে, যা ২০২৭ সালে মানব মহাকাশ যাত্রার লক্ষ্যে কাজ করছে।
শুভাংশু শুক্লা মানসিক স্বাস্থ্য এবং স্ট্রেস হ্রাস নিয়ে ‘অ্যাস্ট্রোমেন্টাল হেলথ’ এবং ‘ইইজি নিউরোফিডব্যাক’ প্রকল্পেও কাজ করেছেন। তিনি ক্রমাগত গ্লুকোজ মনিটর (সিজিএম) পরীক্ষা করেছেন, যা মাইক্রোগ্র্যাভিটিতে এর নির্ভুলতা যাচাই করে এবং ভবিষ্যতে ডায়াবেটিক ব্যক্তিদের মহাকাশ যাত্রার সম্ভাবনা খুলে দিতে পারে।
ভারতের গর্ব, বিশ্বের সঙ্গে সহযোগিতা
মিশনের শেষ দিনগুলোতে শুভাংশু শুক্লা এবং তাঁর দল আইএসএস-এ একটি বিশেষ ভোজসভার আয়োজন করেন, যেখানে ভারতের আমরস, গাজরের হালুয়া এবং পোল্যান্ডের পিয়েরোগির মতো বিভিন্ন দেশের খাবার পরিবেশন করা হয়। এই সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান মহাকাশে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার একটি উজ্জ্বল উদাহরণ হয়ে উঠেছে।
শুভাংশু তাঁর বিদায়ী বক্তৃতায় বলেন, “আজকের ভারত মহাকাশ থেকে উচ্চাভিলাষী, নির্ভীক এবং গর্বিত দেখায়। এখনও ‘সারে জাহাঁ সে আচ্ছা’।” তিনি ১৯৮৪ সালে রাকেশ শর্মার ঐতিহাসিক বক্তব্যের প্রতিধ্বনি তুলে ভারতের মহাকাশ গবেষণার উজ্জ্বল ভবিষ্যতের প্রতি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

পৃথিবীতে ফিরে আসা
অ্যাক্সিওম-৪ দলটি আজ স্পেসএক্স ড্রাগন মহাকাশযানে করে আইএসএস থেকে বিচ্ছিন্ন হবে এবং প্রায় ২৩ ঘণ্টার যাত্রা শেষে ১৫ জুলাই বিকেল ৩:৩০ মিনিটে (ভারতীয় সময়) ক্যালিফোর্নিয়ার উপকূলে সমুদ্রে অবতরণ করবে। এই অবতরণকে বলা হয় ‘স্প্ল্যাশডাউন’। শুভাংশু শুক্লা পৃথিবীতে ফিরে আসার পর সাত দিনের একটি পুনর্বাসন প্রোগ্রামে অংশ নেবেন, যাতে তাঁর শরীর পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণের সঙ্গে পুনরায় খাপ খাইয়ে নিতে পারে।
গগনযানের পথে ভারত
অ্যাক্সিওম-৪ মিশন ভারতের মানব মহাকাশ যাত্রার প্রোগ্রাম ‘গগনযান’-এর জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। ইসরোর প্রায় ৫৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে শুভাংশু শুক্লার এই মিশন ভারতের মহাকাশ গবেষণার ক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। ইসরোর চেয়ারম্যান ভি নারায়ণন এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে শুভাংশুর ভিডিও কলে আলোচনা এই মিশনের কৌশলগত গুরুত্ব তুলে ধরেছে।
শুভাংশু শুক্লার পরিবারও তাঁর এই সাফল্যে গর্বিত। তাঁর মা আশা শুক্লা বলেন, “আমরা তাঁর নিরাপদে ফিরে আসার জন্য প্রার্থনা করছি। তিনি ফিরে এলে তাঁর প্রিয় খাবার তৈরি করে অপেক্ষা করব।” তাঁর বাবা শম্ভু দয়াল শুক্লা বলেন, “আমরা তাঁকে মহাকাশে দেখে আনন্দিত, তিনি সুস্থ ও খুশি আছেন।”
শুভাংশু শুক্লার এই মিশন শুধুমাত্র ভারতের জন্য নয়, বিশ্ব মহাকাশ গবেষণার ক্ষেত্রেও একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। তাঁর গবেষণা ও অভিজ্ঞতা ভবিষ্যতের মহাকাশ অভিযানের জন্য নতুন পথ প্রশস্ত করবে। ভারত এখন গগনযানের মাধ্যমে নিজস্ব মানব মহাকাশ মিশনের দিকে এগিয়ে চলেছে, এবং শুভাংশু শুক্লার এই যাত্রা সেই স্বপ্নের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।
👉 আরও অন্যান্য খবর পড়তে ক্লিক করুন: Bengali News Today

