কেরলের নার্সের মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের পথে, রক্তমূল্য প্রত্যাখ্যান করল পরিবার
ইসলামাবাদ, ১৭ জুলাই ২০২৫: কেরলের নার্স নিমিষা প্রিয়া, যিনি ইয়েমেনে তাঁর ব্যবসায়িক পার্টনার তালাল আবদো মেহদির হত্যার দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত হয়েছেন, তাঁর বিরুদ্ধে ‘কিসাস’ বা ‘ঈশ্বরের আইন’ কার্যকরের দাবি তুলেছেন নিহতের ভাই। ইয়েমেনের শরিয়া আইনের অধীনে ‘কিসাস’ অর্থাৎ ‘চোখের বদলে চোখ’ নীতির ভিত্তিতে প্রতিশোধের দাবি জানিয়ে তালালের পরিবার ‘রক্তমূল্য’ বা ‘দিয়া’ গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছে। এই ঘটনা ভারত ও ইয়েমেনের মধ্যে কূটনৈতিক আলোচনাকে আরও জটিল করে তুলেছে, এবং নিমিষার জীবন বাঁচানোর প্রচেষ্টায় বড় ধরনের ধাক্কা হিসেবে দেখা হচ্ছে।
কেরলের পালক্কাড়ের বাসিন্দা নিমিষা প্রিয়া ২০১১ সালে ভালো চাকরির খোঁজে ইয়েমেনে যান। সেখানে কয়েক বছর হাসপাতালে কাজ করার পর তিনি নিজের মেডিকেল ক্লিনিক খোলার সিদ্ধান্ত নেন। ইয়েমেনের আইন অনুযায়ী, বিদেশি নাগরিকদের ব্যবসা শুরু করতে স্থানীয় পার্টনারের প্রয়োজন হয়, এবং তালাল আবদো মেহদি ছিলেন নিমিষার ব্যবসায়িক পার্টনার। কিছু রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে যে নিমিষা পরবর্তীতে তালালের সঙ্গে বিয়ে করেছিলেন। তবে, তাঁদের সম্পর্কের মধ্যে উত্তেজনা তৈরি হয়, এবং ২০১৭ সালে তালালের মৃত্যুর ঘটনায় নিমিষাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়।
ইয়েমেনের আদালত নিমিষাকে মৃত্যুদণ্ডের সাজা দেয়, এবং তাঁর আপিলও খারিজ হয়ে যায়। তবে, শরিয়া আইনের অধীনে নিহতের পরিবারের কাছ থেকে ক্ষমা পাওয়ার বা ‘দিয়া’ (রক্তমূল্য) প্রদানের মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড এড়ানোর সুযোগ ছিল। নিমিষার পরিবার এবং ‘সেভ নিমিষা প্রিয়া অ্যাকশন কাউন্সিল’ এই দিয়া প্রদানের জন্য প্রায় ৪০ লক্ষ ডলার (প্রায় ৩৩৫ কোটি টাকা) সংগ্রহের চেষ্টা করছিল। কিন্তু নিহত তালালের ভাই স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন, “নিমিষার জন্য কোনো ক্ষমা নেই। তাকে কিসাসের মুখোমুখি হতে হবে।”
‘কিসাস’ কী?
ইসলামি শরিয়া আইনের অধীনে ‘কিসাস’ হলো প্রতিশোধের একটি নীতি, যেখানে ইচ্ছাকৃত অপরাধের জন্য সমান শাস্তি দেওয়া হয়। এটি প্রায়শই ‘চোখের বদলে চোখ’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়। তবে, শরিয়া আইনে নিহতের পরিবারের কাছে ক্ষমা বা ‘দিয়া’ গ্রহণের বিকল্প থাকে। নিমিষার ক্ষেত্রে তালালের পরিবার কোনো আর্থিক ক্ষতিপূরণ গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছে এবং কঠোর শাস্তির দাবি জানিয়েছে।
নিহতের ভাইয়ের মতে, নিমিষা ইচ্ছাকৃতভাবে তালালের হত্যা করেছেন, এবং এই অপরাধের জন্য ‘কিসাস’ই একমাত্র ন্যায়বিচার। তিনি মিডিয়ার ‘রক্তমূল্য’ নিয়ে আলোচনায় ক্ষুব্ধ হয়েছেন এবং বলেছেন, “আমরা প্রতিশোধ চাই, এমনকি যদি শাস্তি বিলম্বিত হয়।” এই অবস্থান নিমিষার জীবন বাঁচানোর সম্ভাবনাকে আরও কঠিন করে তুলেছে।
ভারতের প্রচেষ্টা ও কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ
নিমিষার মৃত্যুদণ্ড স্থগিত করতে ভারত সরকার এবং কেরলের ‘সেভ নিমিষা প্রিয়া অ্যাকশন কাউন্সিল’ নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ইয়েমেনের সঙ্গে কূটনৈতিক আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে, তবে ইয়েমেনের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতা এই প্রক্রিয়াকে জটিল করে তুলেছে। সম্প্রতি, নিহতের ভাইয়ের সঙ্গে একটি বৈঠকে প্রথমবারের মতো তাঁর উপস্থিতি দেখা গেছে, কিন্তু শরিয়া আইন অনুযায়ী পুরো পরিবারের সম্মতি প্রয়োজন, যা এখনও পাওয়া যায়নি।
নিমিষার আইনজীবী সুভাষ চন্দ্রন জানিয়েছেন, “আমরা একটি বড় ধাক্কার মুখে পড়েছি। নিহতের পরিবারের ক্ষমা ছাড়া নিমিষার জীবন বাঁচানোর সম্ভাবনা খুবই কম।” তিনি আরও বলেন, নিমিষা তালালের হাতে দীর্ঘদিন ধরে নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন, যা তাঁর প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে, ইয়েমেনের আদালত এই দাবিকে আমলে নেয়নি।
নিমিষার মামলা ভারতে ব্যাপক আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে। অনেকে দাবি করেছেন যে তিনি তালালের দ্বারা শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন, এবং তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগে এই বিষয়টি বিবেচনা করা উচিত। মানবাধিকার কর্মীরা ইয়েমেনের শরিয়া আইনের কঠোর প্রয়োগ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, বিশেষ করে এই ক্ষেত্রে যেখানে নিমিষার বিরুদ্ধে অভিযোগের পেছনে জটিল পারিবারিক ও ব্যবসায়িক সম্পর্ক জড়িত।
ইয়েমেনে ‘কিসাস’ সাধারণত প্রয়োগ করা হয় না, এবং আধুনিক বিচারব্যবস্থার প্রভাবে এর ব্যবহার কমে এসেছে। তবে, নিহতের পরিবারের অবস্থান এই মামলায় কঠোর শাস্তির দিকে ঝুঁকছে।
নিমিষার মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের নির্দিষ্ট তারিখ এখনও ঘোষণা করা হয়নি, তবে তাঁর আইনজীবী এবং ভারত সরকার শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত কূটনৈতিক ও আইনি প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। নিমিষার পরিবার কেরলে তাঁর জীবন বাঁচানোর জন্য তহবিল সংগ্রহের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে, তবে তালালের পরিবারের দৃঢ় অবস্থান এই প্রচেষ্টাকে কঠিন করে তুলেছে।
এই ঘটনা ভারতীয় প্রবাসী শ্রমিকদের বিদেশে আইনি ও সামাজিক চ্যালেঞ্জের বিষয়টিকে পুনরায় সামনে এনেছে। নিমিষার ভাগ্য এখন ইয়েমেনের শরিয়া আইন এবং ভারতের কূটনৈতিক প্রচেষ্টার উপর নির্ভর করছে। আগামী দিনে এই মামলা কীভাবে এগোয়, তা ভারত ও ইয়েমেনের সম্পর্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হয়ে উঠবে।

