কলকাতার রাজপথে তৃণমূলের ঐক্যবদ্ধ শক্তি প্রদর্শন, কেন্দ্রকে চ্যালেঞ্জ মমতার
কলকাতা, ১৬ জুলাই ২০২৫: পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আজ কলকাতার রাজপথে বৃষ্টি উপেক্ষা করে এক বিশাল প্রতিবাদ মিছিলের নেতৃত্ব দিয়েছেন। বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলোতে বাঙালি ভাষাভাষীদের উপর ‘পরিকল্পিত হেনস্থার’ অভিযোগ তুলে তিনি এই মিছিলের ডাক দিয়েছিলেন। তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং দলের শীর্ষ নেতারা তাঁর সঙ্গে এই মিছিলে অংশ নেন। তিন কিলোমিটার দীর্ঘ এই মিছিলে হাজার হাজার তৃণমূল কর্মী-সমর্থকের উপস্থিতিতে কলকাতার কলেজ স্কোয়ার থেকে ধর্মতলা পর্যন্ত রাজপথ কেঁপে ওঠে। মমতার এই পদক্ষেপ আগামী ২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে বাঙালি অস্মিতাকে কেন্দ্র করে তৃণমূলের রাজনৈতিক কৌশলের একটি শক্তিশালী প্রদর্শন হিসেবে দেখা হচ্ছে।
মিছিলের পটভূমি: বাঙালি হেনস্থার অভিযোগ
তৃণমূল কংগ্রেস গত কয়েক সপ্তাহ ধরে অভিযোগ করে আসছে যে, বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলোতে বাঙালি ভাষাভাষী মানুষদের উপর ভাষাগত পরিচয়ের ভিত্তিতে হেনস্থা করা হচ্ছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দাবি করেছেন, বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলোতে বাঙালিদের ‘অবৈধ অভিবাসী’ বা ‘রোহিঙ্গা’ হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা চলছে। তিনি উল্লেখ করেছেন, ওড়িশায় বাঙালি শ্রমিকদের আটক, দিল্লিতে বাঙালি বস্তিবাসীদের উচ্ছেদ অভিযান এবং আসামের কোচবিহারে এক কৃষকের উপর ‘বিদেশি’ তকমা দেওয়ার মতো ঘটনা এই হেনস্থার প্রমাণ।
মমতা আরও অভিযোগ করেছেন যে, কেন্দ্রীয় সরকার গোপনে একটি নির্দেশনা জারি করেছে, যেখানে বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলোকে সন্দেহভাজন বাংলাদেশি নাগরিকদের আটক করে ডিটেনশন ক্যাম্পে পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন,
“এটি জরুরি অবস্থার চেয়েও গুরুতর। এই নির্দেশনা আমরা চ্যালেঞ্জ করব। বাংলা বললেই কাউকে বাংলাদেশি বলা যায় না।” তিনি কেন্দ্রকে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, “আমাকেও ডিটেনশন ক্যাম্পে পাঠানোর সাহস দেখান। আমি আরও বেশি বাংলায় কথা বলব।”
আজ দুপুর ১:৪৫ মিনিটে কলকাতার কলেজ স্কোয়ার থেকে মিছিল শুরু হয় এবং ধর্মতলার ডোরিনা ক্রসিং পর্যন্ত প্রায় তিন কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে। ভারী বৃষ্টির মধ্যেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তৃণমূলের শীর্ষ নেতারা যেমন ফিরহাদ হাকিম, চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য এবং সমীরুল ইসলাম অটল থাকেন। মিছিলে “বিজেপি, ছি ছি” এবং “খেলা হবে” ধ্বনি কলকাতার রাজপথে প্রতিধ্বনিত হয়। প্রায় ১,৫০০ পুলিশ কর্মী মিছিলের নিরাপত্তার জন্য মোতায়েন ছিলেন।

এসপ্ল্যানেডে মিছিল শেষে এক জনসভায় মমতা বলেন, “২২ লক্ষ বাঙালি শ্রমিক যাঁরা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে কাজ করছেন, তাঁদের বৈধ পরিচয়পত্র রয়েছে। তাঁদের রোহিঙ্গা বলে অপমান করা হচ্ছে। বিজেপির বাঙালি বিরোধী মনোভাবে আমি লজ্জিত ও হতাশ।” তিনি আরও বলেন, “বাংলা ভারতের অংশ নয়? আমাদের ভাষা, আমাদের পরিচয় নিয়ে এই অপমান কেন?”
রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট: ২০২৬ নির্বাচনের প্রস্তুতি
এই মিছিলের সময়টি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। আগামী ২১ জুলাই তৃণমূলের বার্ষিক শহিদ দিবস সমাবেশের আগে এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর পশ্চিমবঙ্গ সফরের একদিন আগে এই মিছিল অনুষ্ঠিত হয়েছে। ২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে তৃণমূল বাঙালি অস্মিতাকে কেন্দ্র করে একটি শক্তিশালী প্রচারণা গড়ে তুলছে। মমতা অভিযোগ করেছেন, বিজেপি ভোটার তালিকা থেকে বাঙালিদের নাম বাদ দেওয়ার চেষ্টা করছে, যেমনটি তারা মহারাষ্ট্র এবং বিহারে করেছে। তিনি বলেন, “বাংলায় এই চক্রান্ত আমরা বন্ধ করব। প্রতি ইঞ্চি লড়াই করব।”
তৃণমূলের নেত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য বলেন, “বাঙালি ভাষা বা পরিচয়ের উপর আক্রমণ কোনোভাবেই মেনে নেওয়া হবে না। বাংলা মাথা নত করবে না।” তৃণমূল আরও অভিযোগ করেছে যে, মহারাষ্ট্রের পুণেতে মাতুয়া সম্প্রদায়ের ছয়জন সদস্য, এমনকি নাবালকদেরও বৈধ পরিচয়পত্র থাকা সত্ত্বেও হেনস্থার শিকার হয়েছেন।
বিজেপির প্রতিক্রিয়া
বিজেপির বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী মমতার এই মিছিলকে ‘রাজনৈতিক নাটক’ বলে কটাক্ষ করেছেন। তিনি অভিযোগ করেন, মমতা ‘বাঙালি অস্মিতা’র নামে অবৈধ বাংলাদেশি অভিবাসী এবং রোহিঙ্গাদের রক্ষা করছেন। তিনি আরও প্রশ্ন তুলেছেন, “রাজ্যে হাজার হাজার বাঙালি শিক্ষক চাকরি হারিয়েছেন, তাঁদের কথা মমতা কেন ভুলে গেলেন?” তিনি মমতার প্রশাসনিক নিয়োগে বাঙালি কর্মকর্তাদের উপেক্ষার অভিযোগও তুলেছেন।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, বাঙালি হেনস্থার বিরুদ্ধে তৃণমূলের এই প্রতিবাদ শুধু বাংলায় সীমাবদ্ধ থাকবে না। তিনি বলেন, “আমরা এই আন্দোলন বাংলার সীমানা ছাড়িয়ে অন্য রাজ্যেও নিয়ে যাব।” তিনি আসাম এবং ওড়িশা সরকারকে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, “যাঁরা বাঙালিদের হেনস্থা করছেন, তাঁদের পরিণতি ভোগ করতে হবে।” তিনি বাংলার বাইরে থাকা শ্রমিকদের নিরাপদে ফিরে আসার আহ্বানও জানিয়েছেন।
মমতা আরও বলেন, “আমার কাছে এক টুকরো রুটি থাকলে, আমি তা অর্ধেক ভাগ করে দেব। বাঙালিদের অপমান আমরা সহ্য করব না।” তিনি নির্বাচন কমিশনের ভোটার তালিকা সংশোধনের প্রস্তাবের বিরোধিতা করে বলেন, “বিহারের পর এবার বাংলায় এই চক্রান্ত চলছে। আমরা তা বন্ধ করব।”
এই মিছিল তৃণমূলের রাজনৈতিক কৌশলের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাঙালি অস্মিতাকে কেন্দ্র করে ভোটারদের আবেগের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের চেষ্টা করছেন। আগামী বিধানসভা নির্বাচনের আগে এই প্রতিবাদ তৃণমূলের জন্য একটি শক্তিশালী প্রচারণার হাতিয়ার হতে পারে। একই সঙ্গে, মোদীর সফরের আগে এই মিছিল বিজেপির বিরুদ্ধে তৃণমূলের আক্রমণাত্মক অবস্থানকে আরও জোরালো করেছে।
কলকাতার এই মিছিলের পাশাপাশি রাজ্যের বিভিন্ন জেলায়ও একই ধরনের প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। তৃণমূলের নেতারা জানিয়েছেন, এই আন্দোলন আগামী দিনে আরও তীব্র হবে। বাঙালি অস্মিতার এই লড়াই কীভাবে রাজনৈতিক সমীকরণকে প্রভাবিত করে, তা আগামী দিনে বাংলার রাজনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হয়ে উঠবে।

