কলকাতা, ২৪ জুলাই ২০২৫: বাংলা চলচ্চিত্রের অমর নক্ষত্র, মহানায়ক উত্তম কুমারের প্রয়াণ দিবসে আজও তাঁর স্মৃতি বাঙালির হৃদয়ে জ্বলজ্বল করে। ১৯৮০ সালের ২৪ জুলাই, মাত্র ৫৩ বছর বয়সে তিনি চিরবিদায় নেন, কিন্তু তাঁর অভিনয়, ক্যারিশমা, এবং বাঙালির মনে গেঁথে থাকা চলচ্চিত্রের উত্তরাধিকার আজও অমলিন। তিনি ছিলেন বাঙালির আবেগ, সংস্কৃতি, এবং স্বপ্নের প্রতীক। এই প্রতিবেদনে আমরা উত্তম কুমারের জীবনী, তাঁর উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র, মৃত্যুর কারণ, অজানা কাহিনী, ব্যক্তিগত জীবন, বাড়ি, ভাই তরুণ কুমার, পুরস্কার, গাড়ি, খাদ্যাভ্যাস, শেষ দিনের বিবরণ, মৃত্যুর পর কী ঘটেছিল, তাঁর সম্পর্কে বই, এবং মোট চলচ্চিত্রের সংখ্যা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।
উত্তম কুমারের জীবনী: একজন সাধারণ ছেলে থেকে মহানায়ক
উত্তম কুমার, আসল নাম অরুণ কুমার চট্টোপাধ্যায়, ১৯২৬ সালের ৩ সেপ্টেম্বর কলকাতার আহিরীটোলায় এক নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা সাতকারী চট্টোপাধ্যায় ছিলেন মেট্রো সিনেমা হলে ফিল্ম প্রজেকশনিস্ট, আর মা ছিলেন চপলা দেবী। তাঁর ডাকনাম ‘উত্তম’ রেখেছিলেন তাঁর দিদিমা। আর্থিক সংকটের কারণে তিনি গোয়েনকা কলেজ অফ কমার্স অ্যান্ড বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে পড়াশোনা শুরু করলেও শেষ করতে পারেননি। তিনি কলকাতা পোর্ট কমিশনারের অফিসে ক্লার্ক হিসেবে কাজ শুরু করেন, মাসিক বেতন ছিল মাত্র ২৭৫ টাকা। তবে তাঁর হৃদয় ছিল মঞ্চে, নাটকে, এবং চলচ্চিত্রে।
তাঁর পরিবারের নাট্যদল ‘সুহৃদ সমাজ’-এর মাধ্যমে তিনি অভিনয়ের প্রথম পাঠ নেন। তাঁর স্বাভাবিক অভিনয়, হাসি, কথার ঢঙ, এবং মুখের অভিব্যক্তি দর্শকদের মন জয় করত। ১৯৪৮ সালে তিনি প্রথম চলচ্চিত্র ‘দৃষ্টিদান’-এ অভিনয় করেন, যা ব্যর্থ হয়। এরপর ‘কামনা’ (১৯৪৯) ছবিও ব্যর্থ হয়, এবং তাঁকে ‘ফ্লপ মাস্টার জেনারেল’ বলা হতো। কিন্তু ১৯৫২ সালে ‘বসু পরিবার’ এবং ১৯৫৩ সালে ‘শাড়ে চুয়াত্তর’-এ সুচিত্রা সেনের সঙ্গে জুটি বেঁধে তিনি বাংলা চলচ্চিত্রে নতুন ইতিহাস রচনা করেন। তিন দশকের ক্যারিয়ারে তিনি ২০৩টি মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন, যার মধ্যে ছিল প্রযোজনা, পরিচালনা, এবং সঙ্গীত রচনার কাজ। তিনি ১৯৬৭ সালে ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’ এবং ‘চিড়িয়াখানা’ ছবির জন্য প্রথম জাতীয় পুরস্কার লাভ করেন।
উত্তম কুমারের উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র
উত্তম কুমারের চলচ্চিত্র তালিকা অত্যন্ত সমৃদ্ধ। তিনি ২০৩টি মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন, যার মধ্যে কিছু আইকনিক ছবি হলো:
- নায়ক (১৯৬৬): সত্যজিৎ রায় পরিচালিত এই ছবিতে উত্তম কুমার একজন জনপ্রিয় অভিনেতা অরিন্দম মুখার্জির চরিত্রে অভিনয় করেন। ট্রেনে এক সাংবাদিকের (শর্মিলা ঠাকুর) সঙ্গে তাঁর কথোপকথন তারকার জীবনের একাকীত্ব ও দ্বন্দ্ব ফুটিয়ে তোলে। এই ছবির জন্য তিনি তৃতীয়বারের মতো বিএফজেএ পুরস্কার পান।
- সপ্তপদী (১৯৬১): সুচিত্রা সেনের সঙ্গে এই রোমান্টিক ছবি বাঙালির প্রেমের সংজ্ঞা বদলে দেয়। কৃষ্ণেন্দু ও রিনা ব্রাউনের প্রেমকাহিনী এবং ‘এই পথ যদি না শেষ হয়’ গানটি আজও অমর।
- অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি (১৯৬৭): এই ছবিতে তিনি একজন পর্তুগিজ-বাঙালি কবিয়ালের ভূমিকায় অভিনয় করেন, যা তাঁর বহুমুখী অভিনয়ের নিদর্শন। এই ছবির জন্য তিনি জাতীয় পুরস্কার পান।
- হারানো সুর (১৯৫৭): সুচিত্রা সেনের সঙ্গে এই ছবি প্রেম ও স্মৃতিহারা এক ব্যক্তির গল্প বলে, যেখানে উত্তম কুমারের আবেগময় অভিনয় দর্শকদের হৃদয় ছুঁয়ে যায়।
- ওগো বধূ সুন্দরী (১৯৮১): তাঁর শেষ ছবি, যা মৃত্যুর পর মুক্তি পায়। এই হাস্যরসাত্মক ছবিতে তিনি তাঁর স্বাভাবিক ক্যারিশমা দিয়ে দর্শকদের মুগ্ধ করেন।
উত্তম কুমার ও সুচিত্রা সেনের জুটি ত্রিশটি ছবিতে বাংলা চলচ্চিত্রে নতুন ধারা সৃষ্টি করে। ‘অগ্নিপরীক্ষা’, ‘শাড়ে চুয়াত্তর’, এবং ‘গৃহদহ’ বাঙালির মনে চিরকালীন স্থান করে নিয়েছে।
উত্তম কুমারের মৃত্যুর কারণ
১৯৮০ সালের ২৪ জুলাই, ‘ওগো বধূ সুন্দরী’ ছবির শুটিং চলাকালীন উত্তম কুমার তাঁর পঞ্চম হৃদরোগে আক্রান্ত হন। তিনি নিজেই গাড়ি চালিয়ে কলকাতার বেল ভিউ ক্লিনিকে যান, যা তাঁর ময়রা স্ট্রিটের বাড়ি থেকে পাঁচ মিনিটের দূরত্বে ছিল। তাঁর চিকিৎসক ডা. লালমোহন মুখার্জি জানিয়েছিলেন যে তাঁর হৃদযন্ত্রের অবস্থা দীর্ঘদিন ধরে খারাপ ছিল, এবং প্রতিটি হার্ট অ্যাটাকের পর পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনা কমে যাচ্ছিল। তিনি সরবিট্রেট বহন করতেন বুকে ব্যথার জন্য, কিন্তু অতিরিক্ত কাজ, ধূমপান, এবং মদ্যপানের অভ্যাস তাঁর স্বাস্থ্যের উপর প্রভাব ফেলে। ১৯৭৮ সালে তাঁর হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার পর তাঁকে কার্ডিয়াক অ্যাজমার রোগ ধরা পড়ে।
২৪ জুলাই সন্ধ্যায় তাঁর অবস্থা কিছুটা ভালো হয়েছিল, এবং তিনি তাঁর ভাই তরুণ কুমারকে একটি নাটকের পারফরম্যান্স মিস না করার জন্য বলেছিলেন। কিন্তু রাত ৯টার পর তাঁর অবস্থা দ্রুত অবনতি হয়, এবং রাত ৯:৩৫-এ তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুর খবরে সমগ্র কলকাতা শোকে স্তব্ধ হয়ে যায়।

অজানা কাহিনী: উত্তম কুমারের ব্যক্তিগত জীবন
উত্তম কুমারের ব্যক্তিগত জীবন ছিল রহস্যময়, আবেগময়, এবং মাঝে মাঝে বিতর্কিত। এখানে তাঁর জীবনের কিছু অজানা গল্প তুলে ধরা হলো:
- শিল্পী সংসদের প্রতিষ্ঠা: ১৯৬৮ সালে উত্তম কুমার ‘শিল্পী সংসদ’ প্রতিষ্ঠা করেন, যা চলচ্চিত্র শিল্পের অবসরপ্রাপ্ত ও অভাবী কলাকুশলীদের জন্য কাজ করত। তিনি নিজে তহবিল সংগ্রহ করে টেকনিশিয়ানদের সাহায্য করতেন। তাঁর মৃত্যুর পর সংগঠনের সদস্যরা তাঁকে ‘ভাইয়ের মতো’ বলে স্মরণ করেন।
- নারী ভক্তদের প্রতি আকর্ষণ: সুপ্রিয়া দেবী এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, উত্তম কুমারের শুটিং স্টুডিওতে মহিলা ভক্তদের ভিড় এতটাই ছিল যে তাঁকে দূরে রাখা কঠিন হয়ে পড়ত। একবার একজন ভক্ত তাঁকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। সুপ্রিয়া হেসে বলেছিলেন, “সবাই উত্তমকে বিয়ে করতে চাইত।”
- নাটকের প্রতি ভালোবাসা: উত্তম কুমারের অভিনয়ের প্রথম ভালোবাসা ছিল নাটক। তিনি ‘লুনার ক্লাব’ নামে একটি নাট্যদল গড়েছিলেন, যেখানে তিনি পোস্টার তৈরি থেকে অভিনয়—সবই করতেন। তাঁর বাবা তাঁর এই প্রতিভা দেখে কখনো বাধা দেননি।
- পার্ক স্ট্রিটের ঘটনা: ১৯৭০-এর দশকে, সুপ্রিয়া দেবী তাঁর পছন্দের একটি খাবার না তৈরি করায় উত্তম কুমার রাগ করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে রাস্তায় হাঁটতে শুরু করেন। শীঘ্রই হাজার হাজার মানুষ তাঁকে ঘিরে ফেলেন। সুপ্রিয়া তাঁর পিছনে ছুটতে ছুটতে জুতো পরতে ভুলে যান, এবং কলকাতার গরম রাস্তায় তাঁর পা পুড়ে যায়। পার্ক স্ট্রিট থানার পুলিশ তাঁকে জিপে করে বাড়ি ফিরিয়ে আনে, যাতে ভিড়ের মধ্যে দুর্ঘটনা না ঘটে। এই ঘটনার পর তিনি সুপ্রিয়ার সঙ্গে এক সপ্তাহ কথা বলেননি।
- নাক্সালাইট ঘটনার সাক্ষী: লেখক রাহুল পুরকায়স্থের বইয়ে উল্লেখ আছে, উত্তম কুমার কলকাতার ময়দানে পুলিশের ‘এনকাউন্টার’ ঘটনার সাক্ষী হয়েছিলেন, যেখানে তিনজন নাক্সালাইটকে গুলি করা হয়। এই ঘটনা তাঁর মনে গভীর প্রভাব ফেলেছিল।
- চুরি যাওয়া টেপ রেকর্ডার: ১৯৮০ সালের ২৩ জুলাই সকালে তাঁর গাড়ি থেকে তাঁর প্রিয় টেপ রেকর্ডার চুরি হয়ে যায়, যা তাঁর শেষ দিনের একটি অশুভ ইঙ্গিত হিসেবে দেখা হয়। একই দিনে তিনি টেকনিশিয়ান স্টুডিওতে তাঁর মেকআপ রুমে একজন তরুণী অভিনেত্রীকে দেখে বিরক্ত হন, যা তাঁর জন্য অস্বাভাবিক ছিল। এই ঘটনার পর তিনি নিউ থিয়েটার্সে ঝড়ের বেগে যান।
- একাকীত্ব ও মানসিক অবস্থা: তাঁর অসম্পূর্ণ আত্মজীবনী ‘আমার আমি’-তে তিনি লিখেছিলেন, “আমার হৃদয়ে জানি—এই আলো, এই উজ্জ্বলতা—কিছুই স্থায়ী নয়। এই আলো যে কোনো মুহূর্তে নিভে যেতে পারে।” এই লেখা তাঁর একাকীত্ব ও মানসিক অবস্থার প্রতিফলন। তাঁর জনপ্রিয়তা তাঁকে একাকী করে তুলেছিল, এবং তিনি প্রায়ই নিজের জীবনের শূন্যতার কথা বলতেন।
উত্তম কুমারের বাড়ি
উত্তম কুমার কলকাতার বিভিন্ন স্থানে বসবাস করতেন। তাঁর প্রধান বাসস্থান ছিল ময়রা স্ট্রিটে, যা বেল ভিউ ক্লিনিক থেকে মাত্র পাঁচ মিনিটের দূরত্বে ছিল। এই বাড়িটি ছিল তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের কেন্দ্র, যেখানে তিনি স্ত্রী গৌরী দেবী, পুত্র গৌতম, এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে থাকতেন। তিনি দক্ষিণ কলকাতার গিরিশ মুখার্জি রোডেও বসবাস করেছিলেন, যেখানে তাঁর পরিবার প্রাথমিকভাবে থাকত। তাঁর বাড়িতে প্রায়ই শিল্পী ও ভক্তদের ভিড় লেগে থাকত। তাঁর মৃত্যুর পর এই বাড়িগুলো তাঁর স্মৃতির অংশ হয়ে ওঠে।
তরুণ কুমার: উত্তমের ছোট ভাই
তরুণ কুমার চট্টোপাধ্যায় (২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৩১ – ২৭ অক্টোবর ২০০৩) ছিলেন উত্তম কুমারের ছোট ভাই এবং একজন প্রখ্যাত বাঙালি চরিত্রাভিনেতা। তিনি ৫০০-এর বেশি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন, যার মধ্যে ‘সপ্তপদী’, ‘ছদ্মবেশী’, ‘জীবন মৃত্যু’, এবং ‘ধন্যি মেয়ে’-তে উত্তম কুমারের পাশে বন্ধু বা সহযোগীর ভূমিকায় অভিনয় করেন। তিনি ‘দাদাঠাকুর’ (১৯৬৬) ছবির জন্য রাষ্ট্রপতি পুরস্কার পান। তরুণ কুমারের ডাকনাম ছিল ‘বুড়ো’, এবং তিনি অভিনেত্রী সুব্রতা চট্টোপাধ্যায়কে ১৯৬২ সালে বিয়ে করেন। তাঁদের একটি কন্যা এবং নাতি সৌরভ ব্যানার্জিও অভিনেতা। তরুণ কুমার উত্তমের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন, এবং তাঁর মৃত্যুর সময় তিনিই প্রথম ফোন পান।
উত্তম কুমারের পুরস্কার
উত্তম কুমার তাঁর ক্যারিয়ারে অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছেন, যা তাঁর অভিনয়ের বৈচিত্র্য ও গুণমানের প্রমাণ:
- জাতীয় পুরস্কার (১৯৬৭): ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’ এবং ‘চিড়িয়াখানা’ ছবির জন্য শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হিসেবে প্রথম জাতীয় পুরস্কার। তিনি ভারতের প্রথম অভিনেতা যিনি এই পুরস্কার পান।
- বিএফজেএ পুরস্কার: আটবার শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হিসেবে বিএফজেএ পুরস্কার, যার মধ্যে ‘নায়ক’ (১৯৬৬) ছবির জন্য তৃতীয়বার পুরস্কৃত হন।
- ফিল্মফেয়ার পুরস্কার: শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হিসেবে ফিল্মফেয়ার পুরস্কার।
- জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (প্রযোজক): তাঁর প্রযোজিত ছবি ‘হারানো সুর’ (১৯৫৭), ‘সপ্তপদী’ (১৯৬১), ‘ভ্রান্তি বিলাস’ (১৯৬৩), এবং ‘উত্তর ফাল্গুনী’ (১৯৬৩) জাতীয় পুরস্কার পায়। তাঁর সম্মানে পশ্চিমবঙ্গ সরকার ২০১২ সালে ‘মহানায়ক সম্মান পুরস্কার’ চালু করে, যা প্রতি বছর তাঁর প্রয়াণ দিবসে দেওয়া হয়।

উত্তম কুমারের গাড়ি
উত্তম কুমার গাড়ির প্রতি ভালোবাসতেন, এবং তাঁর গাড়িগুলো তাঁর তারকা ইমেজের অংশ ছিল। তিনি একটি ফিয়াট গাড়ি ব্যবহার করতেন, যা তাঁর ময়রা স্ট্রিটের বাড়ির কাছে পার্ক করা থাকত। ১৯৮০ সালের ২৩ জুলাই তাঁর প্রিয় টেপ রেকর্ডার এই গাড়ি থেকে চুরি হয়েছিল। তিনি নিজে গাড়ি চালিয়ে বেল ভিউ ক্লিনিকে যান তাঁর শেষ দিনে, যা তাঁর শারীরিক শক্তি এবং স্বাধীনতার প্রতীক ছিল। তাঁর গাড়িগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য সীমিত, তবে তাঁর সহকর্মীরা বলেন, তিনি গাড়ি চালানোর সময় প্রায়ই গান গাইতেন বা ফিল্মের সংলাপ মুখস্থ করতেন।
উত্তম কুমারের খাদ্যাভ্যাস
উত্তম কুমার বাঙালি খাবারের প্রতি ভালোবাসতেন, বিশেষ করে ঘরোয়া খাবার। তিনি ইলিশ মাছ, চিংড়ি মাছের মালাইকারি, এবং শুক্তোর প্রতি দুর্বল ছিলেন। সুপ্রিয়া দেবী বলেছিলেন, তিনি প্রায়ই তাঁর পছন্দের খাবার তৈরি করতে বলতেন, এবং না পেলে রাগ করতেন। তিনি মাঝে মাঝে রান্নাঘরে গিয়ে রান্নার প্রক্রিয়া দেখতেন এবং রসিকতা করতেন। তবে তাঁর ব্যস্ত জীবনযাত্রা এবং মদ্যপানের অভ্যাস তাঁর স্বাস্থ্যের উপর প্রভাব ফেলে। তিনি কফি এবং চায়েরও ভক্ত ছিলেন, এবং শুটিংয়ের ফাঁকে প্রায়ই চা পান করতেন।
শেষ দিনের বিবরণ
১৯৮০ সালের ২৩ জুলাই উত্তম কুমারের জন্য একটি অশান্ত দিন ছিল। সকালে তাঁর গাড়ি থেকে প্রিয় টেপ রেকর্ডার চুরি হয়। টেকনিশিয়ান স্টুডিওতে তাঁর মেকআপ রুমে একজন তরুণী অভিনেত্রীকে দেখে তিনি বিরক্ত হন এবং নিউ থিয়েটার্সে যান। ‘ওগো বধূ সুন্দরী’ ছবির শুটিংয়ে একটি সিঁড়ি দিয়ে ওঠার দৃশ্যে তিনি সাতবার রিটেক নেন, যা তাঁর শারীরিক অবস্থার উপর চাপ ফেলে। পরিচালক সলিল দত্ত তাঁকে থামাতে জোরে হাততালি দিয়ে উৎসাহ দেখান। সন্ধ্যায় তিনি একটি বন্ধুর পার্টিতে যোগ দেন, যা মধ্যরাত পর্যন্ত চলে। মধ্যরাতে তিনি অসুস্থ বোধ করেন এবং নিজে গাড়ি চালিয়ে বেল ভিউ ক্লিনিকে যান। ২৪ জুলাই রাত ৯:৩৫-এ তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
মৃত্যুর পর কী ঘটেছিল
উত্তম কুমারের মৃত্যুর পর কলকাতার দক্ষিণাঞ্চল প্রায় স্তব্ধ হয়ে যায়। ২৫ জুলাই, হাজার হাজার মানুষ তাঁর শেষযাত্রায় শরিক হন। তাঁর দেহ একটি ফুলে সজ্জিত ট্রাকে করে নিয়ে যাওয়া হয়, যেখানে তিনি সাদা পোশাকে শায়িত ছিলেন। ভিড় এতটাই ছিল যে পুরো শহর থমকে যায়। তাঁর স্ত্রী গৌরী দেবী, পুত্র গৌতম, ভাই তরুণ ও বারুন, এবং মা চপলা দেবী শোকে বিহ্বল হয়ে পড়েন। তবে তাঁর দত্তক কন্যা শোমা চৌধুরী (সুপ্রিয়া চৌধুরীর কন্যা) এবং সুপ্রিয়া চৌধুরীকে তাঁর দেহ দেখতে দেওয়া হয়নি, যা বিতর্কের জন্ম দেয়। ১৯৮০-এর দশকের শেষে শোমা তাঁর সম্পত্তির অধিকার নিয়ে মামলা করেন, যা তাঁর পরিবারের সঙ্গে বিচ্ছেদকে আরও গভীর করে। তাঁর মৃত্যুর পর ‘ওগো বধূ সুন্দরী’ (১৯৮১) এবং ‘কালঙ্কিনী কঙ্কাবতী’ মুক্তি পায়, যা বক্স অফিসে সাফল্য পায়।
উত্তম কুমার সম্পর্কে বই
উত্তম কুমার তাঁর জীবদ্দশায় দুটি আত্মজীবনী লেখার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু দুটিই অসম্পূর্ণ থেকে যায়:
- হারানো দিনগুলি মোর (১৯৬০-৬১): এই আত্মজীবনী তিনি শুরু করেন, কিন্তু শেষ করতে পারেননি।
- আমার আমি (১৯৭৯-৮০): এই বইটিও অসম্পূর্ণ থেকে যায়। তাঁর মৃত্যুর দিন এই পাণ্ডুলিপি চুরি হয়ে যায়, তবে পরে ‘দি টাইমস অফ ইন্ডিয়া’-র একজন সদস্য এটি উদ্ধার করেন। তরুণ কুমার এটি শেষ করেন, এবং ২০১০ সালে কলকাতা বইমেলায় সপ্তর্ষি প্রকাশন এটি প্রকাশ করে।
অন্যান্য উল্লেখযোগ্য বই:
- উত্তম কুমার: এ লাইফ ইন সিনেমা (লেখক: সায়নদেব চৌধুরী, ব্লুমসবারি, ২০২১): এটি উত্তম কুমারের জীবন ও চলচ্চিত্রের উপর একটি গবেষণামূলক জীবনী, যা তাঁর বহুমুখী অভিনয় ও শিল্পে অবদানের বিশ্লেষণ করে।
- উত্তম কুমার অ্যান্ড সুচিত্রা সেন: বেঙ্গলি সিনেমার ফার্স্ট কাপল (লেখক: মৈত্রেয়ী বি চৌধুরী, ওম বুকস, ২০১০): এই বই তাঁর ও সুচিত্রা সেনের পর্দার সম্পর্ক এবং জনপ্রিয়তার উপর আলোকপাত করে।
উত্তম কুমারের উত্তরাধিকার
উত্তম কুমারের মৃত্যু বাংলা চলচ্চিত্রের একটি যুগের অবসান ঘটায়। তাঁর সম্মানে টালিগঞ্জ মেট্রো স্টেশনের নামকরণ করা হয় ‘মহানায়ক উত্তম কুমার মেট্রো স্টেশন’। ২০১২ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাঁর নামে ‘মহানায়ক সম্মান পুরস্কার’ চালু করে। ২০২৪ সালে মুক্তি পাওয়া ‘ওতি উত্তম’ ছবিতে তাঁর ৫৪টি ছবির ফুটেজ ব্যবহার করে ভিএফএক্স-এর মাধ্যমে তাঁকে পুনরায় পর্দায় ফিরিয়ে আনা হয়। সত্যজিৎ রায় বলেছিলেন, “উত্তম ছাড়া ‘নায়ক’ ছবি হতো না। তিনি বাংলা চলচ্চিত্রের প্রথম ও শেষ নায়ক।” তাঁর সহজাত ক্যারিশমা, মানবিক গুণাবলী, এবং অভিনয়ের বৈচিত্র্য তাঁকে বাঙালির হৃদয়ে চিরকাল বাঁচিয়ে রাখবে।

