ট্রাম্পের শুল্ক নীতি ও ভারতের কৃষি-দুগ্ধ খাতের উপর চাপ, চুক্তির অগ্রগতি নিয়ে আলোচনা
নয়া দিল্লি/ওয়াশিংটন, ২১ জুলাই ২০২৫: ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে একটি দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তি (বিটিএ) চূড়ান্ত করার প্রচেষ্টা তীব্র গতিতে এগিয়ে চলেছে, তবে এই চুক্তির সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে ভারতীয় অর্থনীতিতে উদ্বেগ বাড়ছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসনের শুল্ক নীতি এবং ভারতের কৃষি ও দুগ্ধ খাতের উপর চাপের কারণে ভারতীয় কৃষক ও গ্রামীণ অর্থনীতির উপর মারাত্মক প্রভাব পড়তে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছে। পাশাপাশি, রাশিয়া-ভারত-চীন (আরআইসি) শীর্ষ সম্মেলনের প্রেক্ষাপটে ভারতের কৌশলগত অবস্থান এই বাণিজ্য আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
বাণিজ্য চুক্তির অগ্রগতি: সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ
ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বাণিজ্য আলোচনা গত কয়েক মাস ধরে তীব্র হয়েছে, বিশেষ করে ১০ এপ্রিল থেকে ট্রাম্প প্রশাসনের ঘোষিত ২৬% শুল্ক স্থগিতের পর। এই শুল্ক স্থগিতের মেয়াদ ৯ জুলাই শেষ হয়, এবং এর আগে একটি অন্তর্বর্তীকালীন চুক্তি চূড়ান্ত করার জন্য উভয় পক্ষ তৎপর। ভারতের বাণিজ্য প্রতিনিধিরা ওয়াশিংটনে তাদের আলোচনার সময়সীমা বাড়িয়েছেন, যা কৃষি, অটোমোবাইল, ইস্পাত এবং ডিজিটাল বাণিজ্যের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে তীব্র আলোচনার ইঙ্গিত দেয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতের কৃষি খাতে বৃহত্তর প্রবেশাধিকার দাবি করছে, বিশেষ করে ভুট্টা, সয়াবিন, তুলা এবং দুগ্ধজাত পণ্যের ক্ষেত্রে। তবে, ভারত এই খাতগুলোতে শুল্ক কমানোর বিরোধিতা করছে, কারণ এটি দেশের ৭০০ মিলিয়ন গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জীবিকার উপর প্রভাব ফেলতে পারে। স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার (এসবিআই) একটি বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, মার্কিন দুগ্ধ পণ্য আমদানির অনুমতি দেওয়া হলে ভারতীয় দুগ্ধশিল্প বছরে ১.০৩ লক্ষ কোটি টাকার ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে। এই খাতটি ভারতের মোট জিভিএ-র ২.৫-৩% অবদান রাখে এবং প্রায় ৮ কোটি মানুষের জীবিকা নির্ভর করে এর উপর।
ভারতীয় বাণিজ্য বিশেষজ্ঞ অজয় শ্রীবাস্তবের মতে, “কৃষি ও দুগ্ধ খাতে শুল্ক কমানো ভারতীয় কৃষকদের জন্য বিপর্যয়কর হতে পারে। এই খাতগুলো রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে স্পর্শকাতর, এবং এখানে কোনো ছাড় দেওয়া সম্ভব নয়।” তিনি আরও বলেন, ট্রাম্প প্রশাসন ২৬% শুল্ক পুনর্বহাল না করে ১০% বেসলাইন শুল্ক বজায় রাখতে পারে, যা ভারতের জন্য তুলনামূলকভাবে কম ক্ষতিকর হবে।
অর্থনৈতিক প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ
ট্রাম্প প্রশাসনের “মেক ইন আমেরিকা” নীতি এবং ভারতের উপর প্রস্তাবিত শুল্ক বৃদ্ধি ভারতীয় রপ্তানি খাতের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভারতের ২০২৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ৪৫.৭ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য উদ্বৃত্ত রয়েছে, এবং শুল্ক বৃদ্ধি এই ভারসাম্যকে ব্যাহত করতে পারে। বিশেষ করে, ইস্পাত, অ্যালুমিনিয়াম, এবং ইলেকট্রনিক্সের মতো খাতে শুল্ক বৃদ্ধি ভারতের রপ্তানি শিল্পের জন্য বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে। অ্যাপলের মতো কোম্পানি, যারা ভারতে উৎপাদন বৃদ্ধি করছে, তাদের সাপ্লাই চেইনেও প্রভাব পড়তে পারে।
ক্রিসিলের একটি প্রতিবেদন অনুসারে, বাণিজ্য চুক্তির ফলে মার্কিন পণ্য ভারতীয় বাজারে প্রতিযোগিতামূলক হয়ে উঠতে পারে, যা ভারতের বাণিজ্য উদ্বৃত্তকে হ্রাস করতে পারে। তবে, এই চুক্তি ভারতের রত্ন ও গহনা, টেক্সটাইল, এবং ফার্মাসিউটিক্যাল খাতে রপ্তানি বৃদ্ধির সুযোগও তৈরি করতে পারে।
আরআইসি শীর্ষ সম্মেলন: ভারতের কৌশলগত ভারসাম্য
রাশিয়া-ভারত-চীন (আরআইসি) শীর্ষ সম্মেলনের প্রেক্ষাপটে ভারতের বৈদেশিক নীতি এবং বাণিজ্য কৌশল আরও জটিল হয়ে উঠেছে। সম্প্রতি বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান মুহাম্মদ ইউনুসের একটি মন্তব্য, যেখানে তিনি বাংলাদেশকে উত্তর-পূর্ব ভারতের জন্য সমুদ্রপথের “অভিভাবক” হিসেবে উল্লেখ করেছেন, ভারতে বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। এই মন্তব্য ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে উত্তেজনা সৃষ্টি করলেও, ভারত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তির মাধ্যমে তার অর্থনৈতিক ও কৌশলগত অবস্থান শক্তিশালী করতে চাইছে।
আরআইসি গোষ্ঠীর মধ্যে ভারত রাশিয়া থেকে সুলভ মূল্যে তেল আমদানি অব্যাহত রেখেছে, যা ভারতের জ্বালানি ব্যয় হ্রাস করেছে। তবে, ট্রাম্প প্রশাসন ভারতের এই কৌশলের উপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে, বিশেষ করে মার্কিন তেল, এলএনজি, এবং প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম ক্রয়ের দাবি জোরদার করার মাধ্যমে।
সম্ভাব্য সুবিধা ও ভবিষ্যৎ পথ
বাণিজ্য চুক্তির মাধ্যমে ভারত মার্কিন বাজারে জৈব খাদ্য, মশলা, এবং ফলমূলের রপ্তানি বৃদ্ধির সুযোগ পেতে পারে। এসবিআই-এর বিশ্লেষণ অনুসারে, এই খাতে রপ্তানি ৩ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত বাড়তে পারে। এছাড়া, ভিসা নিয়ম শিথিলকরণ, কোল্ড স্টোরেজে মার্কিন বিনিয়োগ, এবং কৃষি প্রযুক্তির ক্ষেত্রে সহযোগিতা ভারতের অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক হতে পারে।
তবে, ভারতের অর্থনীতির উপর মার্কিন শুল্ক নীতির সম্ভাব্য ধ্বংসাত্মক প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ রয়ে গেছে। ট্রাম্পের “ট্যারিফ কিং” হিসেবে ভারতকে চিহ্নিত করা এবং শুল্ক বৃদ্ধির হুমকি ভারতীয় রপ্তানিকারকদের জন্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে। বিশ্লেষকরা মনে করেন, ভারতকে তার কৃষি ও দুগ্ধ খাতের সুরক্ষার পাশাপাশি বাণিজ্য চুক্তির মাধ্যমে সুবিধা আদায়ের জন্য কৌশলগত ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে।
আগামী কয়েক দিনে ভারত-মার্কিন আলোচনার ফলাফল ভারতীয় অর্থনীতির ভবিষ্যৎ পথ নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। এই চুক্তি শুধু অর্থনৈতিক নয়, বরং ভারতের কৌশলগত অবস্থান এবং আরআইসি গোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রেও দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলবে।

