কলকাতা, ২৪ জুলাই ২০২৫: ভারত এবং যুক্তরাজ্যের মধ্যে একটি যুগান্তকারী মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (FTA) স্বাক্ষরিত হয়েছে, যা দুই দেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে। এই চুক্তি, যা ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে আলোচনার পর ৬ মে ২০২৫-এ চূড়ান্ত হয় এবং ২৪ জুলাই ২০২৫-এ আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাক্ষরিত হয়, দুই দেশের জন্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক মাইলফলক। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার এই চুক্তিকে “ঐতিহাসিক” এবং “পারস্পরিকভাবে উপকারী” বলে অভিহিত করেছেন। এই প্রতিবেদনে আমরা এই চুক্তির বিস্তারিত বিবরণ, এর অর্থনৈতিক প্রভাব, এবং ভারতীয় ও ব্রিটিশ নাগরিকদের জন্য এর তাৎপর্য নিয়ে আলোচনা করব।
চুক্তির মূল বিষয়বস্তু: কী কী অন্তর্ভুক্ত?
ভারত-ইউকে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি বিভিন্ন খাতে শুল্ক হ্রাস এবং বাণিজ্য সহজীকরণের মাধ্যমে দুই দেশের অর্থনীতিকে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে গঠিত। এই চুক্তির মূল দিকগুলো হল:
- শুল্ক হ্রাস:
- ভারতের জন্য: চুক্তির অধীনে, ভারতের ৯৯% রপ্তানি পণ্য যুক্তরাজ্যে শুল্কমুক্ত প্রবেশের সুযোগ পাবে। এর মধ্যে রয়েছে টেক্সটাইল, পাদুকা, রত্ন ও জুয়েলারি, সামুদ্রিক পণ্য, কৃষিপণ্য এবং প্রক্রিয়াজাত খাদ্য। এটি ভারতের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (MSME), কৃষক এবং মৎস্যজীবীদের জন্য বিশেষভাবে উপকারী হবে।
- যুক্তরাজ্যের জন্য: ভারত যুক্তরাজ্যের ৯০% পণ্যের উপর শুল্ক হ্রাস করবে, যার মধ্যে ৮৫% পণ্য আগামী দশকের মধ্যে সম্পূর্ণ শুল্কমুক্ত হবে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল হুইস্কি এবং জিন (শুল্ক ১৫০% থেকে ৭৫% এবং দশ বছর পর ৪০%), অটোমোবাইল (১০০% থেকে ১০%), প্রসাধনী, চিকিৎসা সরঞ্জাম, মেশিনারি, মাংস, স্যামন, চকোলেট এবং বিস্কুট। এই শুল্ক হ্রাস প্রথম বছরেই যুক্তরাজ্যের রপ্তানিতে ৪০০ মিলিয়ন পাউন্ড এবং দশ বছর পর ৯০০ মিলিয়ন পাউন্ড সাশ্রয় করবে।
- সেবা খাতে প্রবেশাধিকার:
- যুক্তরাজ্যের সেবা প্রতিষ্ঠানগুলো, বিশেষ করে লন্ডন ও দক্ষিণ-পূর্ব ইংল্যান্ডের আর্থিক ও পেশাদার সেবা প্রতিষ্ঠান, ভারতের দ্রুত বর্ধনশীল সেবা অর্থনীতিতে প্রবেশাধিকার পাবে। ২০২২ সালে এই অঞ্চল থেকে ভারতে ৩.৬ বিলিয়ন পাউন্ডের সেবা রপ্তানি হয়েছিল।
- ভারতীয় পেশাদাররা, যেমন যোগ প্রশিক্ষক, সঙ্গীতজ্ঞ এবং শেফ, যুক্তরাজ্যে অস্থায়ীভাবে কাজ করার সুযোগ পাবেন। তবে, এই চুক্তিতে ভারতীয় ছাত্র বা পেশাদারদের জন্য ভিসা নীতিতে কোনো পরিবর্তন অন্তর্ভুক্ত হয়নি।
- সোশ্যাল সিকিউরিটি ছাড় (ডাবল কন্ট্রিবিউশন কনভেনশন):
- ভারতীয় এবং ব্রিটিশ কর্মী, যারা অস্থায়ীভাবে অন্য দেশে কাজ করছেন, তাদের তিন বছরের জন্য সোশ্যাল সিকিউরিটি পেমেন্টে ছাড় দেওয়া হবে। এর মানে, ভারতীয় কর্মীরা যুক্তরাজ্যে এবং ব্রিটিশ কর্মীরা ভারতে কাজ করার সময় শুধুমাত্র নিজ দেশে সোশ্যাল সিকিউরিটি প্রদান করবেন। এটি ভারতের জন্য একটি বড় অর্জন, যদিও যুক্তরাজ্যের বিরোধী দল এটিকে সমালোচনা করেছে।
- শুল্ক প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা:
- দুই দেশই শুল্ক-সংক্রান্ত আইন, নিয়ম এবং প্রক্রিয়াগুলো ইংরেজিতে অনলাইনে প্রকাশ করতে সম্মত হয়েছে। এটি ব্যবসায়ীদের জন্য শুল্ক প্রক্রিয়া সহজ করবে এবং বাণিজ্যকে আরও দ্রুত এবং স্বচ্ছ করবে।
- পরিবেশগত প্রতিশ্রুতি:
- এই চুক্তিতে ভারত তার ইতিহাসে সর্বোচ্চ পরিবেশগত প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে নবায়নযোগ্য শক্তি সরঞ্জামের বাণিজ্য সহজীকরণ। এটি দুই দেশের নেট জিরো লক্ষ্যকে সমর্থন করবে।
অর্থনৈতিক প্রভাব: ভারত ও যুক্তরাজ্যের জন্য কী অর্জন?
এই চুক্তি দুই দেশের অর্থনীতির জন্য উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলবে বলে আশা করা হচ্ছে:
- ভারতের জন্য:
- ২০২৪ সালে ভারত ও যুক্তরাজ্যের মধ্যে বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ৪২.৬ বিলিয়ন পাউন্ড। এই চুক্তির ফলে ২০৪০ সালের মধ্যে বাণিজ্য ২৫.৫ বিলিয়ন পাউন্ড (৩৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার) বৃদ্ধি পাবে।
- ভারতের রপ্তানি খাত, বিশেষ করে টেক্সটাইল, পাদুকা, রত্ন ও গহনা, এবং কৃষিপণ্য, যুক্তরাজ্যের বাজারে আরও প্রতিযোগিতামূলক হবে। এটি ভারতের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প এবং কৃষকদের জন্য নতুন সম্ভাবনা তৈরি করবে।
- ভারতীয় গ্রাহকরা যুক্তরাজ্যের তৈরি প্রসাধনী, চিকিৎসা সরঞ্জাম, এবং এয়ারোস্পেস পণ্য কম দামে পাবেন।
- ভারতের ২০৩০ সালের মধ্যে ১ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার রপ্তানির লক্ষ্য পূরণে এই চুক্তি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
- যুক্তরাজ্যের জন্য:
- যুক্তরাজ্যের অর্থনীতিতে বার্ষিক ৪.৮ বিলিয়ন পাউন্ড এবং মজুরিতে ২.২ বিলিয়ন পাউন্ড বৃদ্ধি পাবে।
- স্কচ হুইস্কি শিল্প এই চুক্তি থেকে ব্যাপকভাবে উপকৃত হবে, কারণ ভারত বিশ্বের বৃহত্তম হুইস্কি বাজার। স্কচ হুইস্কি অ্যাসোসিয়েশনের মতে, এই চুক্তি আগামী পাঁচ বছরে ১ বিলিয়ন পাউন্ড রপ্তানি বৃদ্ধি এবং ১,২০০টি নতুন চাকরি সৃষ্টি করবে।
- যুক্তরাজ্যের অটোমোবাইল, প্রসাধনী, এবং চিকিৎসা সরঞ্জাম শিল্প ভারতের বিশাল বাজারে প্রবেশাধিকার পাবে, যা ২০২৮ সালের মধ্যে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হবে।
- ব্রিটিশ গ্রাহকরা ভারতীয় পোশাক, পাদুকা, এবং হিমায়িত চিংড়ির মতো পণ্য কম দামে এবং বেশি বৈচিত্র্যে পাবেন।

চুক্তির পটভূমি: কেন এত গুরুত্বপূর্ণ?
ভারত এবং যুক্তরাজ্যের মধ্যে এই চুক্তি ২০২২ সালে শুরু হওয়া ১৫টি আলোচনার পর্যায়ের ফলাফল। প্রাথমিকভাবে, তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন ২০২২ সালের দীপাবলির মধ্যে চুক্তি সম্পন্ন করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিলেন, কিন্তু ভিসা, সোশ্যাল সিকিউরিটি, এবং শুল্ক হ্রাস নিয়ে জটিলতার কারণে আলোচনা বিলম্বিত হয়। ২০২৫ সালে নতুন ব্রিটিশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারের নেতৃত্বে আলোচনা ত্বরান্বিত হয়, এবং ভারতের বাণিজ্যমন্ত্রী পীযূষ গোয়াল এবং ব্রিটিশ বাণিজ্যমন্ত্রী জনাথন রেনল্ডস লন্ডনে চূড়ান্ত আলোচনার মাধ্যমে এটি সম্পন্ন করেন।
এই চুক্তি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ কারণ এটি যুক্তরাজ্যের ব্রেক্সিট-পরবর্তী চতুর্থ এবং সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বাণিজ্য চুক্তি, এবং ভারতের কোনো ইউরোপীয় দেশের সঙ্গে প্রথম বিস্তৃত মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি। বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য উত্তেজনা, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন শুল্ক নীতির প্রেক্ষাপটে, এই চুক্তি দুই দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বাড়াবে।
ভারতীয় বাঙালি সম্প্রদায়ের জন্য তাৎপর্য
যুক্তরাজ্যে প্রায় ১৯ লক্ষ ভারতীয় বংশোদ্ভূত মানুষ বাস করেন, যার মধ্যে বাঙালি সম্প্রদায় একটি উল্লেখযোগ্য অংশ। এই চুক্তি বাঙালি ব্যবসায়ীদের জন্য নতুন সম্ভাবনা তৈরি করবে, বিশেষ করে টেক্সটাইল, গহনা, এবং খাদ্যপণ্য রপ্তানিতে। বাংলার মৎস্যজীবী এবং কৃষকরা যুক্তরাজ্যের বাজারে সামুদ্রিক পণ্য এবং প্রক্রিয়াজাত খাদ্য রপ্তানি করে উপকৃত হবেন। এছাড়া, বাঙালি গ্রাহকরা যুক্তরাজ্যের তৈরি উচ্চমানের পণ্য, যেমন প্রসাধনী এবং চিকিৎসা সরঞ্জাম, সাশ্রয়ী মূল্যে পাবেন।
বাঙালি পেশাদাররা, বিশেষ করে যারা সঙ্গীত, নৃত্য, বা অন্যান্য সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে কাজ করেন, তারা যুক্তরাজ্যে অস্থায়ী কাজের সুযোগ পাবেন। এটি পশ্চিমবঙ্গের সাংস্কৃতিক রপ্তানি এবং দুই দেশের মধ্যে সাংস্কৃতিক বিনিময়কে উৎসাহিত করবে।
চ্যালেঞ্জ এবং সমালোচনা
যদিও এই চুক্তি ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়েছে, যুক্তরাজ্যে কিছু বিরোধী দল এটির সমালোচনা করেছে। বিরোধী নেতা কেমি ব্যাডেনক এবং ছায়া বাণিজ্যমন্ত্রী অ্যান্ড্রু গ্রিফিথ সোশ্যাল সিকিউরিটি ছাড়কে “ব্রিটিশ ব্যবসায়ীদের জন্য ক্ষতিকর” বলে অভিহিত করেছেন। তারা দাবি করেছেন যে এটি ব্রিটিশ কর্মীদের তুলনায় ভারতীয় কর্মীদের জন্য অসম প্রতিযোগিতা তৈরি করবে। তবে, ব্রিটিশ বাণিজ্যমন্ত্রী জনাথন রেনল্ডস জানিয়েছেন যে এই ধরনের চুক্তি ইউরোপীয় ইউনিয়ন, দক্ষিণ কোরিয়া, এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেও রয়েছে, এবং এটি ব্রিটিশ কর্মীদের জন্যও সমান সুবিধা প্রদান করে।
ভারতে, কিছু বিশ্লেষক মনে করেন যে যুক্তরাজ্যের কার্বন বর্ডার অ্যাডজাস্টমেন্ট মেকানিজম (CBAM) থেকে ছাড় না পাওয়া একটি সীমাবদ্ধতা। তবে, এই বিষয়ে পৃথক আলোচনা চলছে।

ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
এই চুক্তি ভারত-ইউকে সম্পর্ককে ২০৩৫ সালের মধ্যে একটি “বিস্তৃত কৌশলগত অংশীদারিত্বে” উন্নীত করার লক্ষ্যে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এটি শুধুমাত্র অর্থনৈতিক সহযোগিতাই নয়, শিক্ষা, সংস্কৃতি, এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রেও সহযোগিতা বাড়াবে। ভারতের দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতি এবং যুক্তরাজ্যের উন্নত শিল্প ও সেবা খাতের সমন্বয়ে এই চুক্তি দুই দেশের জন্যই একটি জয়-জয় পরিস্থিতি তৈরি করবে।
চুক্তিটি আগামী এক বছরের মধ্যে কার্যকর হবে, যখন ব্রিটিশ পার্লামেন্ট এটি অনুমোদন করবে। এর পাশাপাশি, একটি দ্বিপাক্ষিক বিনিয়োগ চুক্তি (BIT) নিয়েও আলোচনা চলছে, যা দুই দেশের বিনিয়োগকারীদের জন্য আরও সুরক্ষা প্রদান করবে
ভারত-ইউকে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি দুই দেশের অর্থনৈতিক সম্পর্কের একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। এটি ভারতের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, কৃষক, এবং পেশাদারদের জন্য নতুন দ্বার উন্মোচন করবে, এবং যুক্তরাজ্যের শিল্প ও গ্রাহকদের জন্য ভারতের বিশাল বাজারে প্রবেশের সুযোগ তৈরি করবে। বাঙালি সম্প্রদায়, যারা ভারত ও যুক্তরাজ্য উভয় দেশেই উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি রাখে, এই চুক্তি থেকে বিশেষভাবে উপকৃত হবে। বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য উত্তেজনার মধ্যেও এই চুক্তি একটি আশার আলো, যা মুক্ত বাণিজ্য এবং সহযোগিতার মাধ্যমে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি নিশ্চিত করবে।


https://bengalinewstoday.in/2025/07/24/india-uk-free-trade-agreement-2025-details/