রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য নিয়ে ন্যাটোর ‘দ্বৈত মানদণ্ড’ নিয়ে সতর্ক করল ভারত
নয়াদিল্লি, ১৮ জুলাই ২০২৫: ন্যাটো মহাসচিব মার্ক রুটের রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যরত দেশগুলোর বিরুদ্ধে ‘১০০ শতাংশ সেকেন্ডারি স্যাংশন’ বা দ্বিতীয় স্তরের নিষেধাজ্ঞার হুঁশিয়ারির জবাবে ভারত কড়া প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল বৃহস্পতিবার জানিয়েছেন, ভারতের জনগণের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা দেশের প্রধান অগ্রাধিকার। তিনি ন্যাটোর এই হুমকিকে ‘দ্বৈত মানদণ্ড’ হিসেবে আখ্যায়িত করে সতর্ক করেছেন এবং বলেছেন, ভারতের জ্বালানি ক্রয় বাজারের প্রাপ্যতা এবং বৈশ্বিক পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে। এই প্রতিক্রিয়া ভারতের কৌশলগত স্বাধীনতা এবং জাতীয় স্বার্থ রক্ষার প্রতি দৃঢ় অবস্থানের প্রতিফলন।
ন্যাটো মহাসচিব মার্ক রুটে বুধবার মার্কিন সিনেটরদের সঙ্গে বৈঠকের পর সাংবাদিকদের জানান, ভারত, চীন এবং ব্রাজিলের মতো দেশগুলো যদি রাশিয়ার সঙ্গে তেল ও গ্যাস বাণিজ্য চালিয়ে যায়, তবে তাদের বিরুদ্ধে ‘১০০ শতাংশ সেকেন্ডারি স্যাংশন’ আরোপ করা হবে। তিনি এই দেশগুলোর নেতাদের রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে ফোনে কথা বলে ইউক্রেনের সঙ্গে শান্তি আলোচনায় গুরুত্ব দেওয়ার আহ্বান জানান। রুটের এই মন্তব্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের একটি ঘোষণার পর আসে, যিনি ইউক্রেনের সঙ্গে শান্তি চুক্তি না হলে ৫০ দিনের মধ্যে রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যরত দেশগুলোর উপর ১০০ শতাংশ শুল্ক আরোপের হুমকি দিয়েছেন।
রুটে বলেন, “আপনি যদি দিল্লি, বেইজিং বা ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট হন, তবে এই বিষয়টির দিকে নজর দেওয়া উচিত, কারণ এটি আপনাদের উপর বিরাট প্রভাব ফেলবে।” তিনি আরও বলেন, এই দেশগুলোর নেতাদের পুতিনকে শান্তি আলোচনার জন্য চাপ দেওয়া উচিত, নতুবা অর্থনৈতিকভাবে ‘বিশাল ক্ষতি’ হবে।
ভারতের কড়া জবাব
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল বৃহস্পতিবার নয়াদিল্লিতে সাপ্তাহিক মিডিয়া ব্রিফিংয়ে বলেন, “আমরা এই বিষয়ে রিপোর্ট দেখেছি এবং ঘটনাবলি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছি। আমি পুনর্ব্যক্ত করছি, আমাদের জনগণের জ্বালানি চাহিদা নিশ্চিত করা আমাদের জন্য সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। এই প্রচেষ্টায় আমরা বাজারে যা পাওয়া যায় এবং বৈশ্বিক পরিস্থিতির দ্বারা পরিচালিত হই। আমরা বিশেষভাবে এই বিষয়ে কোনো দ্বৈত মানদণ্ডের বিরুদ্ধে সতর্ক করছি।”
জয়সওয়ালের এই বক্তব্য ভারতের দীর্ঘদিনের কৌশলগত স্বাধীনতার নীতির প্রতিফলন। তিনি পরোক্ষভাবে পশ্চিমা দেশগুলোর ‘দ্বৈত মানদণ্ড’ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, কারণ ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং ন্যাটোর সদস্য দেশ তুরস্কও ২০২২ সাল থেকে রাশিয়ার তেল ও গ্যাসের বড় ক্রেতা। সেন্টার ফর রিসার্চ অন এনার্জি অ্যান্ড ক্লিন এয়ারের তথ্য অনুযায়ী, ইউরোপীয় ইউনিয়ন রাশিয়ার তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস এবং পাইপলাইন গ্যাসের বৃহত্তম ক্রেতা, এবং তুরস্ক রাশিয়ার তেল পণ্যের সবচেয়ে বড় ক্রেতা।
ভারতের জ্বালানি নিরাপত্তা: রাশিয়ার ভূমিকা
ভারত তার জ্বালানি চাহিদার প্রায় ৮৮ শতাংশ আমদানির উপর নির্ভর করে, এবং রাশিয়া গত তিন বছরে ভারতের তেল আমদানির প্রধান উৎস হয়ে উঠেছে। বর্তমানে ভারতের মোট তেল আমদানির প্রায় ৪০ শতাংশ রাশিয়া থেকে আসে। ২০২২ সালে ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণের পর পশ্চিমা দেশগুলো রাশিয়ার তেল বর্জন করলে, রাশিয়া ইরাক ও সৌদি আরবের মতো প্রথাগত সরবরাহকারীদের ছাড়িয়ে ভারতের শীর্ষ তেল সরবরাহকারী হয়ে ওঠে।
পেট্রোলিয়াম ও প্রাকৃতিক গ্যাস মন্ত্রী হরদীপ সিং পুরি বৃহস্পতিবার বলেছেন, রাশিয়ার তেল সরবরাহে কোনো বাধা এলে ভারত গায়ানা, ব্রাজিল এবং কানাডার মতো বিকল্প উৎস থেকে তেলের চাহিদা পূরণ করতে পারবে। তিনি জানান, “আমি মোটেও চিন্তিত নই। যদি কিছু ঘটে, আমরা তা মোকাবিলা করব।” তিনি আরও বলেন, রাশিয়ার তেল আমদানি ভারতের জন্য ‘নির্ভরতা’ নয়, বরং সাশ্রয়ী মূল্যে তেল কেনার একটি কৌশলগত পদক্ষেপ।
রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক প্রেক্ষাপট
ন্যাটোর এই হুঁশিয়ারি এমন এক সময়ে এসেছে যখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইউক্রেনকে নতুন অস্ত্র সরবরাহ এবং রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যরত দেশগুলোর উপর কঠোর শুল্ক আরোপের হুমকি দিয়েছেন। ট্রাম্প ৫০ দিনের মধ্যে ইউক্রেনের সঙ্গে শান্তি চুক্তি না হলে রাশিয়ার উপর ‘কঠোর শুল্ক’ আরোপের কথা বলেছেন। তিনি বিশেষভাবে ভারত, চীন বা ব্রাজিলের নাম উল্লেখ না করলেও, এই দেশগুলো রাশিয়ার তেল ও পেট্রোলিয়াম পণ্যের বড় ক্রেতা।
ট্রাম্পের এই হুমকি ব্রিকস দেশগুলোর প্রতি তাঁর সমালোচনার অংশ। এই মাসের শুরুতে তিনি ব্রিকস সদস্য দেশগুলোর উপর আমেরিকায় রপ্তানির ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ অতিরিক্ত শুল্ক আরোপের হুমকি দিয়েছেন, দাবি করে যে ব্রিকস আমেরিকা-বিরোধী নীতি গ্রহণ করছে।

ভারতের কৌশলগত স্বাধীনতা
ভারতের প্রতিক্রিয়া দেশের দীর্ঘদিনের কৌশলগত স্বাধীনতার নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। ভারত ঐতিহাসিকভাবে পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখেছে, তবে রাশিয়ার সঙ্গে তার দীর্ঘস্থায়ী অংশীদারিত্বও রয়েছে। রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের তেল আমদানি ২০২২ সালের আগে মাত্র ২ শতাংশ ছিল, কিন্তু ইউক্রেন যুদ্ধের পর সাশ্রয়ী মূল্যে তেল কেনার সুযোগ গ্রহণ করে ভারত তার আমদানি বাড়িয়েছে।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, ন্যাটোর এই হুঁশিয়ারি ভারতের জ্বালানি নীতির উপর সরাসরি প্রভাব ফেলবে না, কারণ ভারত ইতিমধ্যে মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা এবং আমেরিকা থেকে তেল আমদানি করে তার সরবরাহ বৈচিত্র্যময় করেছে। তবে, এই ঘটনা ভারত-মার্কিন সম্পর্ক এবং ব্রিকসের ক্রমবর্ধমান প্রভাবের প্রেক্ষাপটে নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
উপসংহার
ন্যাটো মহাসচিবের হুঁশিয়ারি এবং ভারতের জবাব বৈশ্বিক কূটনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তকে চিহ্নিত করেছে। ভারতের জ্বালানি নিরাপত্তা এবং কৌশলগত স্বাধীনতার উপর জোর দেওয়া দেশের ১৪০ কোটি মানুষের স্বার্থ রক্ষার প্রতিশ্রুতি প্রতিফলিত করে। যদিও ন্যাটোর হুমকি ভারত, চীন এবং ব্রাজিলের মতো দেশগুলোর উপর অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি করতে পারে, ভারতের দৃঢ় অবস্থান এবং বৈচিত্র্যময় জ্বালানি উৎস এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার ক্ষেত্রে শক্তি যোগাবে। আগামী দিনে এই কূটনৈতিক টানাপোড়েন কীভাবে বৈশ্বিক সম্পর্ককে প্রভাবিত করে, তা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা হবে।

