লন্ডন, ৪ আগস্ট ২০২৫: ভারতীয় ক্রিকেট দল ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে পঞ্চম টেস্ট ম্যাচে এক অবিশ্বাস্য জয় ছিনিয়ে এনেছে, যা ক্রিকেট ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। দ্য ওভালে অনুষ্ঠিত এই ম্যাচে ভারত মাত্র ৬ রানের ব্যবধানে জয়লাভ করে, যা ভারতের টেস্ট ইতিহাসের সবচেয়ে কাছাকাছি জয়। মোহাম্মদ সিরাজের অসাধারণ বোলিং এবং শুভমান গিলের নেতৃত্বে ভারত ২-২ ফলাফলে সিরিজ সমতায় ফিরিয়ে এনেছে। এই ম্যাচের শেষ দিনের নাটকীয় মুহূর্তগুলো ক্রিকেটপ্রেমীদের মনে চিরস্থায়ী ছাপ রেখেছে।
ম্যাচের টার্নিং পয়েন্ট: সিরাজের পাঁচ উইকেট
ম্যাচের চতুর্থ দিন বৃষ্টি ও খারাপ আলোর কারণে খেলা বন্ধ হওয়ার পর পঞ্চম দিনে ইংল্যান্ডের জয়ের জন্য প্রয়োজন ছিল মাত্র ৩৫ রান, হাতে তিনটি উইকেট। হ্যারি ব্রুক (১১১) ও জো রুটের (১২২) দুর্দান্ত সেঞ্চুরির সুবাদে ইংল্যান্ড ৩৭৩ রানের লক্ষ্য তাড়া করতে গিয়ে একসময় জয়ের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিল। কিন্তু মোহাম্মদ সিরাজের অগ্নিঝরা বোলিং ইংল্যান্ডের স্বপ্ন ভেঙে দেয়। সিরাজ পাঁচ উইকেট নিয়ে ম্যাচের নায়ক হন, যার মধ্যে ব্রুকের উইকেট ছিল ম্যাচের টার্নিং পয়েন্ট। তিনি আকাশ দীপের সঙ্গে মিলে ইংল্যান্ডের মিডল অর্ডার ভেঙে দেন। শেষ মুহূর্তে ক্রিস ওকস, যিনি কাঁধের চোট নিয়ে মাঠে নেমেছিলেন, তাঁর প্রতিরোধও ভাঙতে সক্ষম হন সিরাজ।
প্রসিদ্ধ কৃষ্ণাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন, তিনি রুট ও জ্যাকব বেথেলের উইকেট তুলে নিয়ে ভারতের জয়ের পথ সুগম করেন। ম্যাচের শেষ মুহূর্তে ওকসের সঙ্গে গাস অ্যাটকিনসনের জুটি ভারতকে চাপে ফেলেছিল, কিন্তু সিরাজের ধারাবাহিক বোলিং এবং শুভমান গিলের কৌশলগত ফিল্ডিং সেটিং ইংল্যান্ডকে হতাশ করে।

ক্রিকেট কিংবদন্তিদের প্রশংসা
এই ঐতিহাসিক জয় নিয়ে ক্রিকেট কিংবদন্তিরা তাঁদের মতামত জানিয়েছেন। সুনীল গাভাস্কার বলেন, “শুভমান গিল ও মোহাম্মদ সিরাজের কৌশল ইংল্যান্ডকে পুরোপুরি অপ্রস্তুত করে দিয়েছে। সিরাজের ফুলার লেংথের ডেলিভারি ও গিলের ফিল্ডিং প্লেসমেন্ট ছিল দুর্দান্ত। এই জয় ভারতীয় ক্রিকেটের শক্তি ও চরিত্রের প্রমাণ।”
ইংল্যান্ডের সাবেক অধিনায়ক মাইকেল ভন টুইটারে লিখেছেন, “এটি টেস্ট ক্রিকেটের সেরা ম্যাচগুলোর একটি। ভারতের প্রত্যাবর্তন এবং সিরাজের আগ্রাসী বোলিং ছিল অসাধারণ। ইংল্যান্ডের জন্য এটি একটি কঠিন পরাজয়, কিন্তু তারা পুরো সিরিজে দারুণ লড়াই করেছে।”
সচিন তেন্ডুলকার সামাজিক মাধ্যমে লিখেছেন, “মোহাম্মদ সিরাজের এই পারফরম্যান্স আমাদের ২০২১ সালের গাব্বা জয়ের কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। শুভমান গিলের নেতৃত্বে ভারতীয় দল যে একতা ও আবেগ দেখিয়েছে, তা সত্যিই প্রশংসনীয়। টেস্ট ক্রিকেটের এই রোমাঞ্চই এই ফরম্যাটকে অতুলনীয় করে।”
রবি শাস্ত্রী বলেন, “দ্য ওভালে এই জয় টেস্ট ক্রিকেটের জাদু। সিরাজ ও প্রসিদ্ধের বোলিং এবং গিলের ক্যাপ্টেন্সি দেখে মনে হলো ভারত কখনো হাল ছাড়ে না। এই ম্যাচ প্রতিটি ক্রিকেটপ্রেমীর জন্য একটি উৎসব।”
ম্যাচের নাটকীয় মুহূর্ত
চতুর্থ দিনে বৃষ্টির কারণে খেলা বন্ধ হওয়ার আগে ইংল্যান্ডের স্কোর ছিল ৩৩৮/৬, জয়ের জন্য প্রয়োজন ছিল মাত্র ৩৫ রান। হ্যারি ব্রুক ও জো রুটের ১৯৫ রানের জুটি ইংল্যান্ডকে জয়ের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ভারতীয় সমর্থকদের উৎসাহ ও সিরাজের অধ্যবসায় ইংল্যান্ডের স্বপ্ন ভেঙে দেয়। সিরাজের একটি দুর্দান্ত ইনসুইংয়ারে ইংল্যান্ড অধিনায়ক অলি পোপ আউট হন, যা ম্যাচের গতিপথ বদলে দেয়। এরপর রুট ও বেথেলের উইকেট দ্রুত পতন ইংল্যান্ডকে চাপে ফেলে। শেষ মুহূর্তে ক্রিস ওকস, যিনি এক হাতে স্লিং পরে ব্যাট করতে নেমেছিলেন, তাঁর প্রতিরোধও ভারতের জয়ের সামনে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি।
ভারতীয় সমর্থকদের ভূমিকা
ম্যাচের চতুর্থ ও পঞ্চম দিনে ভারতীয় সমর্থকদের উৎসাহ ছিল অতুলনীয়। দ্য ওভালের গ্যালারিতে ভারতীয় সমর্থকদের উচ্চকণ্ঠ উল্লাস দলকে নতুন শক্তি জোগায়। সিরাজ ও গিল মাঠে সমর্থকদের দিকে তাকিয়ে বুক চাপড়ে তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। এই সমর্থনই ভারতকে কঠিন মুহূর্তে লড়াই চালিয়ে যেতে উৎসাহিত করেছে।
এই জয়ের মাধ্যমে ভারত পাঁচ ম্যাচের সিরিজে ২-২ ফলাফলে সমতা ফিরিয়ে এনেছে। সিরিজের প্রথম টেস্টে ইংল্যান্ড ৩৭১ রানের লক্ষ্য তাড়া করে জয় পায়, যেখানে বেন ডাকেটের ১৪৯ রানের ইনিংস ছিল মুখ্য ভূমিকায়। দ্বিতীয় টেস্টে ভারত এডবাস্টনে ৩৩৬ রানের বড় জয় অর্জন করে। তৃতীয় টেস্টে ইংল্যান্ড ২২ রানের জয় পায়, যেখানে রবীন্দ্র জাদেজার ৬১ রানের অপরাজিত ইনিংস ভারতকে জয়ের কাছাকাছি নিয়ে গিয়েছিল। চতুর্থ টেস্টে জাদেজা ও ওয়াশিংটন সুন্দরের সেঞ্চুরির সুবাদে ভারত একটি ঐতিহাসিক ড্র অর্জন করে। এবং এখন পঞ্চম টেস্টে ভারতের এই জয় সিরিজকে একটি নাটকীয় সমাপ্তি দিয়েছে।
দ্য ওভালে ভারতের এই জয় টেস্ট ক্রিকেটের অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণের প্রমাণ। মোহাম্মদ সিরাজের বোলিং, শুভমান গিলের নেতৃত্ব এবং ভারতীয় দলের অদম্য মনোভাব এই ম্যাচকে অবিস্মরণীয় করে তুলেছে। ক্রিকেট কিংবদন্তিদের প্রশংসা এবং সমর্থকদের উৎসাহ এই জয়কে আরও বিশেষ করে দিয়েছে। ভারতীয় ক্রিকেটের এই ঐতিহাসিক মুহূর্ত ভক্তদের মনে দীর্ঘদিন ধরে থাকবে।

