কলকাতার ইতিহাসে এক অজানা নায়কের নাম আজও গোপন রয়ে গেছে – তিনি হলেন গোপাল পাঠা। পেশায় ছিলেন কসাই, তবে ১৯৪৬ সালের ভয়ঙ্কর গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং-এর সময় তাঁর ভূমিকাই তাঁকে শহরের অনন্য নায়ক হিসেবে চিহ্নিত করে। সাত দশক পেরিয়ে গেলেও গোপাল পাঠার উত্তরাধিকার এখনও অদাবিকৃত, তাঁর পরিচয় এখনও সাধারণ মানুষের কাছে এক রোমাঞ্চকর কল্পনার মতো।
দাঙ্গার ভয়াবহ দিনগুলো
১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট, “ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে”-তে এক ভয়াবহ দাঙ্গা গ্রাস করেছিল কলকাতাকে। হঠাৎই ধর্মীয় বিভাজন, রাজনৈতিক উত্তেজনা এবং সহিংসতা এমন রূপ নেয় যে শহর রণোঙ্গনে পরিণত হয়। সেই সময়েই দাঁড়িয়ে যান গোপাল পাঠা।
তিনি এক সাধারণ কসাই হলেও, সংগঠিত করেন এলাকার যুবকদের। ঢাল-তলোয়ার নয়, হাতে তুলে নেন লাঠি ও নিজের পেশার ছুরি। দাঙ্গার প্রতিরোধে তিনি গড়ে তোলেন এক আত্মরক্ষী বাহিনী, যা আজকের দিনে অনেকে “লোকীয় প্রতিরক্ষা বাহিনী” হিসেবেই বিবেচনা করেন। বহু পরিবার তাঁর উদ্যোগেই রক্ষা পেয়েছিল বলে দাবি করা হয়।

বিতর্ক ও সমালোচনা
তবে গোপাল পাঠাকে ঘিরে বিতর্কও কম নয়। কেউ কেউ তাঁকে নায়ক মনে করেন, আবার কেউ মনে করেন তাঁর কঠোর পদক্ষেপ ছিল সহিংসতারই আরেক রূপ। ইতিহাসবিদদের মতে, গোপাল পাঠার ভূমিকাকে সম্পূর্ণ সাদা কিংবা কালো রঙে আঁকা যায় না। কিন্তু একটি বিষয় স্পষ্ট—কলকাতা শহরের বুকে তাঁর ভূমিকা ইতিহাসে অমোচনীয় হয়ে রয়েছে।

সিনেমা ও জনআলোচনায় প্রত্যাবর্তন
সাম্প্রতিক সময়ে গোপাল পাঠার চরিত্রকে কেন্দ্র করে চলচ্চিত্র নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এতে যেমন নতুন প্রজন্ম তাঁর গল্প জানতে পারছে, তেমনি বিতর্কও উস্কে উঠেছে। একদিকে মানুষ তাঁকে কলকাতার রক্ষাকর্তা হিসাবে দেখছেন, অন্যদিকে কিছু গোষ্ঠী তাঁর পদক্ষেপের নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে।
চলচ্চিত্রকে ঘিরে সমালোচনার মূল কারণ—ইতিহাসকে কীভাবে উপস্থাপন করা হবে, সহিংসতার দাগ মুছে ফেলা না স্মরণ করানো—এই দ্বিধা।
উত্তরাধিকার ও আজকের প্রেক্ষাপট
স্বাধীনতার সাত দশকেরও বেশি সময় পরও প্রশ্ন থেকেই যায়—গোপাল পাঠার উত্তরাধিকার কে গ্রহণ করবে? তাঁর জীবনের কাহিনি আসলে এক টুকরো স্মৃতি, যা বাংলার ইতিহাসের এক নির্মম অথচ গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়কে সামনে আনে।
আজ যখন সমাজে বিভাজনের রাজনীতি আবার মাথা তুলছে, গোপাল পাঠার গল্প আমাদের শুধু ইতিহাস নয়, সহাবস্থানের মূল্যকেও মনে করিয়ে দেয়।

