ক্লাবগুলির জন্য আর্থিক সহায়তা ও সর্বধর্ম সমন্বয়ের বার্তা, পুজো কার্নিভাল ৫ অক্টোবর
কলকাতা, ৩১ জুলাই ২০২৫: পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দুর্গাপুজো ২০২৫-এর জন্য রাজ্যের পুজো কমিটিগুলির প্রতি বড়সড় আর্থিক উপহার ঘোষণা করেছেন। এ বছর প্রতিটি পুজো কমিটি ১ লক্ষ ১০ হাজার টাকা করে অনুদান পাবে, যা গত বছরের ৮৫ হাজার টাকার তুলনায় ২৫ হাজার টাকা বেশি। এছাড়াও, বিদ্যুৎ বিলে ৮০ শতাংশ ছাড় এবং ফায়ার লাইসেন্স ফি মকুবের ঘোষণা করেছেন তিনি। বৃহস্পতিবার নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে পুজো কমিটিগুলির সঙ্গে এক প্রশাসনিক বৈঠকে এই ঘোষণা করেন মুখ্যমন্ত্রী, যা রাজ্যের ৪৫ হাজারেরও বেশি ক্লাবের জন্য আনন্দের সংবাদ।
পুজো অনুদানের যাত্রা: ১০ হাজার থেকে ১ লক্ষ ১০ হাজার
২০১৮ সালে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম দুর্গাপুজোর জন্য রাজ্যের ক্লাবগুলিকে ১০ হাজার টাকা করে অনুদান দেওয়ার উদ্যোগ নেন। সেই সময় বিদ্যুৎ বিলে ২৫ শতাংশ ছাড়ের ব্যবস্থাও করা হয়। ২০১৯ সালে এই অনুদান বেড়ে হয় ২৫ হাজার টাকা। করোনাকালে, ২০২০ সালে, আর্থিক সংকটের মধ্যেও পুজোর উৎসবকে জনপ্রিয় করতে অনুদান এক লাফে ৫০ হাজার টাকায় উন্নীত করা হয়। ২০২২ সালে এটি ৬০ হাজার, ২০২৩ সালে ৭০ হাজার এবং ২০২৪ সালে ৮৫ হাজার টাকায় পৌঁছায়। গত বছর মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন যে ২০২৫ সালে অনুদান ১ লক্ষ টাকা করা হবে। তবে, বৈঠকে পুজো কমিটির প্রতিনিধিদের উৎসাহ এবং মুখ্যমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি স্মরণ করিয়ে দেওয়ার পর তিনি ১ লক্ষ ১০ হাজার টাকার ঘোষণা করেন, যা উপস্থিত সকলকে বিস্মিত ও আনন্দিত করে।
বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী মজা করে প্রথমে ৯০ হাজার, তারপর ৯৫ হাজার টাকার কথা বলেন। কিন্তু পুজো কমিটির সদস্যরা তাঁর প্রতিশ্রুতির কথা মনে করিয়ে দিলে তিনি হেসে বলেন, “আমি ভুলে গিয়েছিলাম, ঠিক আছে, ১ লক্ষ ১০ হাজার টাকা করে দেওয়া হবে!” এই ঘোষণার পর ‘জয় বাংলা’ শ্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়াম।
বিদ্যুৎ বিলে ছাড় ও অন্যান্য সুবিধা
এই বছর পুজো কমিটিগুলি বিদ্যুৎ বিলে ৮০ শতাংশ ছাড় পাবে, যা গত বছরের তুলনায় উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি। সিইএসসি এবং রাজ্য বিদ্যুৎ বণ্টন পর্ষদকে এই ছাড় প্রদানের নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। এছাড়াও, ফায়ার লাইসেন্স ফি এবং অন্যান্য সরকারি ফি সম্পূর্ণ মকুব করা হয়েছে। এই সুবিধাগুলি পুজো কমিটিগুলির আর্থিক বোঝা কমিয়ে উৎসবকে আরও জাঁকজমকপূর্ণ করতে সহায়তা করবে।
মুখ্যমন্ত্রী আরও ঘোষণা করেছেন যে, পুজো কার্নিভাল ৫ অক্টোবর কলকাতায় অনুষ্ঠিত হবে। প্রতিমা বিসর্জন ২, ৩ এবং ৪ অক্টোবর তিন দিন ধরে চলবে। তিনি কলকাতা পুলিশ এবং রাজ্য পুলিশকে সমন্বয়ের সঙ্গে কাজ করার নির্দেশ দিয়েছেন, বিশেষ করে মহিলাদের নিরাপত্তার উপর জোর দিয়ে।
সর্বধর্ম সমন্বয়ের বার্তা
বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী সর্বধর্ম সমন্বয়ের উপর জোর দিয়ে বলেন, “বাংলার দুর্গাপুজো কেবল একটি ধর্মীয় উৎসব নয়, এটি জাতীয় উৎসব, প্রাণের উৎসব। এখানে দুর্গাপুজো, সরস্বতী পুজো, লক্ষ্মী পুজো, গণপতি পুজো—সবই হয়। কেউ কেউ বলেন, আমি পুজো করতে দিই না। এটা ঠিক নয়। বাংলায় ঘরে ঘরে উৎসব হয়।” তিনি আরও বলেন, “কেউ কেউ এই বৈঠক নিয়ে আদালতে যায়। কিন্তু পুজো মানে আবেগ, সংস্কৃতি। এতে অনেকে কাজ পায়, জীবিকা পায়।”
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় উল্লেখ করেন যে, ইউনেসকো দুর্গাপুজোকে বিশ্ব ঐতিহ্যের মর্যাদা দিয়েছে। পুজোর সময় রাজ্যের ছোট-বড় শিল্প প্রায় ৪০-৫০ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা করে, যা লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবিকার সঙ্গে জড়িত। পুজো কমিটিগুলি সারা বছর সামাজিক কাজ করে, তাই তাদের উৎসাহ দেওয়া সরকারের দায়িত্ব।
পুজোর প্রস্তুতি ও আর্থিক প্রভাব
রাজ্যের ৪৫ হাজারেরও বেশি পুজো কমিটি এই অনুদান পাবে, যা মোট ৪৪০০ কোটি টাকারও বেশি ব্যয়ের সমান। এই অর্থ পুজোর জাঁকজমক বাড়ানোর পাশাপাশি স্থানীয় অর্থনীতিকে চাঙ্গা করবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই অনুদান এবং বিদ্যুৎ বিলে ছাড় ক্লাবগুলির আর্থিক চাপ কমিয়ে উৎসবের সৃজনশীলতা ও সাংস্কৃতিক মান বাড়াবে।
২০২৫ সালের দুর্গাপুজোর জন্য মহালয়া ২১ সেপ্টেম্বর এবং মহাষষ্ঠী ২৮ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হবে। এই বছর পুজো কিছুটা এগিয়ে আসায় প্রস্তুতি তুঙ্গে। মুখ্যমন্ত্রীর এই ঘোষণা ক্লাবগুলির প্রস্তুতিতে নতুন উৎসাহ যোগ করেছে।
বিতর্ক ও সমালোচনা
যদিও মুখ্যমন্ত্রীর এই ঘোষণা পুজো কমিটিগুলির মধ্যে উৎসাহের সঞ্চার করেছে, কিছু সমালোচক এই অনুদানের সময় নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। এক্স-এ কেউ কেউ মন্তব্য করেছেন যে, এই অর্থ চাকরি সৃষ্টি বা ডিএ বৃদ্ধির মতো অন্যান্য জরুরি খাতে ব্যবহার করা যেত। তবে, রাজ্য সরকারের যুক্তি, দুর্গাপুজো শুধু ধর্মীয় উৎসব নয়, বাংলার সংস্কৃতি ও অর্থনীতির সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত।
অতীতে এই অনুদান নিয়ে আদালতে মামলা হলেও, রাজ্য সরকার সফলভাবে তাদের অবস্থান রক্ষা করেছে। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “এই অনুদান বাংলার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে টিকিয়ে রাখার জন্য। এটি শুধু পুজো নয়, এটি আমাদের পরিচয়।”
উপসংহার
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই ঘোষণা দুর্গাপুজো ২০২৫-কে আরও জাঁকজমকপূর্ণ করতে প্রস্তুত। ১ লক্ষ ১০ হাজার টাকার অনুদান, বিদ্যুৎ বিলে ৮০ শতাংশ ছাড় এবং ফি মকুবের মাধ্যমে রাজ্য সরকার পুজো কমিটিগুলির পাশে দাঁড়িয়েছে। এই উদ্যোগ শুধু উৎসবের উৎকর্ষতাই বাড়াবে না, বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও অর্থনীতিকে নতুন গতি দেবে। পুজোর এই প্রাণের উৎসব বাংলার মানুষের মনে আনন্দের জোয়ার এনে দেবে।

