১৭ বছর পর সাতজন অভিযুক্তের খালাস
মহারাষ্ট্রের নাসিক জেলার মালেগাঁও শহরে ২০০৮ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর একটি মর্মান্তিক বিস্ফোরণ ঘটেছিল, যা ভারতের সন্ত্রাসবাদ সংক্রান্ত মামলাগুলোর মধ্যে একটি বিতর্কিত ও সংবেদনশীল ঘটনা হিসেবে আলোচিত হয়ে আসছে। প্রায় ১৭ বছর পর, ৩১ জুলাই ২০২৫-এ, মুম্বইয়ের একটি বিশেষ এনআইএ (ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি) আদালত এই মামলায় সাতজন অভিযুক্তকে খালাস দিয়েছে। অভিযুক্তদের মধ্যে রয়েছেন প্রাক্তন বিজেপি সাংসদ সাধ্বী প্রজ্ঞা সিং ঠাকুর এবং লেফটেন্যান্ট কর্নেল প্রসাদ পুরোহিত। আদালতের রায়ে বলা হয়েছে, প্রসিকিউশন পর্যাপ্ত প্রমাণ উপস্থাপন করতে ব্যর্থ হয়েছে এবং অভিযুক্তরা সন্দেহের সুবিধা পাওয়ার যোগ্য। এই নিবন্ধে আমরা মালেগাঁও বিস্ফোরণ মামলার পটভূমি, তদন্তের ধারাবাহিকতা, এবং সর্বশেষ রায়ের বিশদ বিবরণ তুলে ধরব।
মালেগাঁও বিস্ফোরণ: ঘটনার পটভূমি
২০০৮ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর, মহারাষ্ট্রের মালেগাঁও শহরের ভিকু চকের কাছে একটি মসজিদের সামনে একটি মোটরসাইকেলে বাঁধা বোমা বিস্ফোরিত হয়। এই বিস্ফোরণে ছয়জন নিহত এবং প্রায় ৯৫ জন আহত হন। ঘটনাটি ঘটেছিল রমজান মাসে, যখন মুসলিম সম্প্রদায় উপবাস পালন করছিল, এবং নবরাত্রি উৎসবের ঠিক আগে। মালেগাঁও, একটি মুসলিম-অধ্যুষিত এলাকা হওয়ায়, এই বিস্ফোরণ সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে পরিকল্পিত বলে সন্দেহ করা হয়।
প্রাথমিকভাবে, মহারাষ্ট্রের অ্যান্টি-টেররিজম স্কোয়াড (এটিএস) তদন্ত শুরু করে এবং সন্দেহের তীর ছিল স্টুডেন্টস ইসলামিক মুভমেন্ট অফ ইন্ডিয়া (সিমি)-এর দিকে। তবে, তদন্তে নাটকীয় মোড় আসে যখন ২০০৮ সালের অক্টোবরে এটিএস অভিযোগ করে যে এই বিস্ফোরণের পিছনে হিন্দু উগ্রপন্থী গোষ্ঠী অভিনব ভারতের হাত রয়েছে। এই অভিযোগ ভারতের সন্ত্রাসবাদ সংক্রান্ত মামলায় প্রথমবারের মতো হিন্দু উগ্রপন্থীদের জড়িত করার ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হয়।
তদন্তের ধারাবাহিকতা
২০০৮-২০১১: এটিএস-এর তদন্ত
মহারাষ্ট্র এটিএস, যার নেতৃত্বে ছিলেন হেমন্ত কারকারে, তদন্তে জানায় যে বিস্ফোরণে ব্যবহৃত মোটরসাইকেলটি সাধ্বী প্রজ্ঞা সিং ঠাকুরের নামে নিবন্ধিত ছিল। এটিএস অভিযোগ করে যে প্রজ্ঞা ঠাকুর এবং লেফটেন্যান্ট কর্নেল প্রসাদ পুরোহিত, যিনি অভিনব ভারতের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, এই বিস্ফোরণের পরিকল্পনা করেছিলেন। পুরোহিতের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল যে তিনি আরডিএক্স (একটি শক্তিশালী বিস্ফোরক) সরবরাহ করেছিলেন এবং ষড়যন্ত্রে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন। ২০০৮ সালের নভেম্বরে প্রজ্ঞা ঠাকুর, পুরোহিত এবং আরও কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
তবে, তদন্তের সময় হেমন্ত কারকারে ২৬/১১ মুম্বই হামলায় নিহত হন, যা মামলার গতিকে আরও জটিল করে তোলে। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মহারাষ্ট্র কন্ট্রোল অফ অর্গানাইজড ক্রাইম অ্যাক্ট (এমসিওসিএ), আনলফুল অ্যাকটিভিটিস (প্রিভেনশন) অ্যাক্ট (ইউএপিএ) এবং ভারতীয় দণ্ডবিধির বিভিন্ন ধারায় অভিযোগ গঠন করা হয়।
২০১১: এনআইএ-এর হাতে তদন্ত হস্তান্তর
২০১১ সালে মামলাটি এনআইএ-এর হাতে হস্তান্তর করা হয়। এনআইএ তদন্তে এটিএস-এর কিছু সিদ্ধান্তের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে এবং ২০১৬ সালে এমসিওসিএ ধারাগুলো বাতিল করে। তবে, ইউএপিএ এবং ভারতীয় দণ্ডবিধির ধারাগুলো বহাল রাখা হয়। এনআইএ-এর তদন্তে প্রজ্ঞা ঠাকুরের বিরুদ্ধে প্রমাণ দুর্বল বলে মনে হয়, এবং তারা তাকে খালাস দেওয়ার প্রস্তাব করে, কিন্তু আদালত তা প্রত্যাখ্যান করে।
২০১৭ সালে প্রজ্ঞা ঠাকুর এবং ২০১৭ সালে পুরোহিত জামিনে মুক্তি পান। অন্যান্য অভিযুক্তরাও পরবর্তীতে জামিন পান। এনআইএ ৩২৩ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ করে, যার মধ্যে ৩৭ জন প্রতিকূল হয়ে যান এবং ২৬ জন সাক্ষ্য দেওয়ার আগেই মারা যান।
২০২৫-এর রায়: অভিযুক্তদের খালাস
৩১ জুলাই ২০২৫-এ, বিশেষ এনআইএ আদালতের বিচারক এ.কে. লাহোটি রায় ঘোষণা করেন। আদালত বলে, “প্রসিকিউশন বিস্ফোরণের ঘটনা প্রমাণ করলেও, এটি প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছে যে বোমাটি মোটরসাইকেলে স্থাপিত হয়েছিল।” এছাড়া, আদালত উল্লেখ করে যে মোটরসাইকেলের চ্যাসিস নম্বর মুছে ফেলা হয়েছিল এবং ইঞ্জিন নম্বর স্পষ্ট ছিল না, তাই এটি প্রজ্ঞা ঠাকুরের মালিকানাধীন বলে প্রমাণিত হয়নি। পুরোহিতের বিরুদ্ধে আরডিএক্স সরবরাহ বা বোমা তৈরির কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
আদালত আরও বলে, “ইউএপিএ-এর ধারাগুলো এই মামলায় প্রযোজ্য নয়, এবং অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কোনো নির্ভরযোগ্য ও সুস্পষ্ট প্রমাণ নেই।” ফলে, সাতজন অভিযুক্ত—প্রজ্ঞা সিং ঠাকুর, প্রসাদ পুরোহিত, মেজর (অব.) রমেশ উপাধ্যায়, অজয় রাহিরকর, সমীর কুলকর্নি, সুধাকর চতুর্বেদী এবং সুধাকর ধর দ্বিবেদী—কে খালাস দেওয়া হয়। আদালত মহারাষ্ট্র সরকারকে নির্দেশ দেয় নিহতদের পরিবারকে ২ লক্ষ টাকা এবং আহতদের ৫০,০০০ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য।

অভিযুক্তদের প্রতিক্রিয়া
রায় ঘোষণার পর প্রজ্ঞা ঠাকুর আদালতের উদ্দেশে বলেন, “আমি শুরু থেকেই বলে আসছি, আমাকে অবৈধভাবে ১৩ দিন আটক রাখা হয়েছিল এবং নির্যাতন করা হয়েছিল। আমি একজন সন্ন্যাসিনী হিসেবে জীবনযাপন করছিলাম, কিন্তু আমাকে সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এই মামলা আমার জীবন ধ্বংস করেছে।” তিনি আরও অভিযোগ করেন যে এটি ‘ভগবা’ (হিন্দুত্ব) কলঙ্কিত করার ষড়যন্ত্র ছিল।
পুরোহিত দাবি করেন, তিনি একজন সামরিক গোয়েন্দা কর্মকর্তা হিসেবে অভিনব ভারতে অনুপ্রবেশ করেছিলেন এবং তার উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে নিয়মিত রিপোর্ট করতেন। তিনি তদন্তে প্রক্রিয়াগত ত্রুটি এবং নির্যাতনের অভিযোগ তুলেন।
মামলার তাৎপর্য ও সমালোচনা
মালেগাঁও বিস্ফোরণ মামলা ভারতের বিচার ব্যবস্থা, তদন্ত প্রক্রিয়া এবং সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এটিএস-এর প্রাথমিক তদন্তে হিন্দু উগ্রপন্থীদের জড়িত করার অভিযোগ উঠলেও, এনআইএ-এর তদন্তে প্রমাণের অভাব এই মামলার জটিলতা বাড়িয়েছে। সমালোচকরা বলছেন, তদন্তে পক্ষপাতিত্ব এবং প্রক্রিয়াগত ত্রুটির কারণে ন্যায়বিচার বিলম্বিত হয়েছে।
এআইএমআইএম-এর নেতা ইমতিয়াজ জলিল প্রশ্ন তুলেছেন, “এই মামলায় মিথ্যা প্রমাণ তৈরি করল কে? এই তদন্তকারী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে?” ভুক্তভোগীদের পরিবার, যেমন একজন বাবা যিনি তার ১০ বছরের মেয়েকে হারিয়েছেন, বলেছেন, “এই রায় আমার জন্য শান্তি আনেনি। আমরা ন্যায়বিচারের আশা হারিয়েছি।”
এই রায় মালেগাঁওয়ের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি এবং ভারতের সন্ত্রাসবাদ তদন্তের উপর নতুন প্রশ্ন তুলেছে। মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফড়নবিস এবং উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ রায়কে স্বাগত জানিয়ে বলেছেন, “সন্ত্রাসবাদ কখনোই ভগবা হতে পারে না।” তবে, ভুক্তভোগীদের পরিবার এবং কিছু রাজনৈতিক দল এই রায়কে ‘ন্যায়বিচারের ব্যর্থতা’ হিসেবে দেখছে।
মালেগাঁও বিস্ফোরণ মামলা ভারতের বিচার ব্যবস্থার জটিলতা এবং সন্ত্রাসবাদ তদন্তের চ্যালেঞ্জগুলো তুলে ধরেছে। ১৭ বছরের দীর্ঘ বিচার প্রক্রিয়ার পর সাতজন অভিযুক্তের খালাস এই ঘটনার ন্যায়বিচার নিয়ে নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। ভুক্তভোগীদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশ সত্ত্বেও, অনেকে মনে করছেন যে এই মামলার প্রকৃত সত্য এখনও অধরা।

