কোচবিহার, ৫ আগস্ট ২০২৫: পশ্চিমবঙ্গের বিরোধী দলনেতা এবং বিজেপি নেতা শুভেন্দু অধিকারীর কনভয়ে মঙ্গলবার কোচবিহারে হামলার ঘটনা ঘটেছে, যা রাজ্যের রাজনৈতিক উত্তেজনাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। শুভেন্দু অধিকারী কোচবিহারের খাগড়াবাড়ি এলাকায় একটি প্রতিবাদী মিছিলে যোগ দিতে যাচ্ছিলেন, যখন তাঁর কনভয়ে কথিত তৃণমূল কংগ্রেসের সমর্থকরা হামলা চালায় বলে অভিযোগ। বিজেপি এই ঘটনাকে ‘পূর্বপরিকল্পিত’ বলে অভিহিত করেছে, যখন তৃণমূল কংগ্রেস (টিএমসি) এই অভিযোগকে ‘ভালোভাবে সাজানো নাটক’ বলে উড়িয়ে দিয়েছে। এই ঘটনা রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন তুলেছে।
হামলার বিবরণ: কী ঘটেছিল?
শুভেন্দু অধিকারী, যিনি পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় বিরোধী দলনেতা, কোচবিহারে জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয়ের সামনে বিজেপির একটি প্রতিবাদী মিছিলে নেতৃত্ব দিতে যাচ্ছিলেন। এই মিছিলের উদ্দেশ্য ছিল রাজ্যে মহিলাদের বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান অপরাধ এবং বিজেপি প্রতিনিধিদের উপর সাম্প্রতিক হামলার প্রতিবাদ। দুপুর ১২:৩৫ নাগাদ তাঁর কনভয় খাগড়াবাড়ি ক্রসিংয়ের কাছে পৌঁছলে, একদল বিক্ষোভকারী তৃণমূলের পতাকা ও কালো পতাকা নিয়ে কনভয়ের দিকে ছুটে আসে। বিক্ষোভকারীরা ‘ফিরে যাও’ স্লোগান দিতে শুরু করে এবং অধিকারীর গাড়ির দিকে জুতো ছুঁড়ে মারে। কনভয়ের অন্তত একটি গাড়ি, যার মধ্যে পুলিশের এসকর্ট গাড়িও ছিল, ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যার কাচ ভেঙে যায়।
শুভেন্দু অধিকারী, যিনি একটি বুলেটপ্রুফ গাড়িতে ভ্রমণ করছিলেন, জানিয়েছেন যে এই বুলেটপ্রুফ গাড়ির কারণে তিনি প্রাণে বেঁচে গেছেন। তিনি বলেন, “আমি জানতাম এমন কিছু ঘটতে পারে। তবুও আমি কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশ মেনে প্রতিবাদে যোগ দিতে এসেছিলাম।” তিনি রাজ্যের মুখ্যসচিব মনোজ পান্ত, রাজ্যের স্বরাষ্ট্রসচিব নন্দিনী চক্রবর্তী এবং রাজ্য পুলিশের মহানির্দেশক রাজীব কুমারের কাছে এই ‘নিরাপত্তা ত্রুটি’ নিয়ে চিঠি লিখবেন বলে জানিয়েছেন।
বিজেপি বনাম তৃণমূল: অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ
বিজেপি এই হামলার জন্য তৃণমূল কংগ্রেসকে দায়ী করেছে। বিজেপির রাজ্য সভাপতি ও রাজ্যসভার সাংসদ সামিক ভট্টাচার্য বলেছেন, “এটি তৃণমূলের পূর্বপরিকল্পিত হামলা, যা তাদের নোংরা রাজনৈতিক পথ প্রকাশ করে।” তিনি আরও জানিয়েছেন, এই ঘটনার প্রতিবাদে রাজ্যজুড়ে বিক্ষোভের ডাক দেওয়া হয়েছে। বিজেপি নেতারা দাবি করেছেন, তৃণমূলের ১৯টি সমান্তরাল কর্মসূচি ইচ্ছাকৃতভাবে শুভেন্দুর গতিবিধি ঘিরে সাজানো হয়েছিল।
অন্যদিকে, তৃণমূল কংগ্রেস এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে। উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী এবং কোচবিহারের দিনহাটার তৃণমূল বিধায়ক উদয়ন গুহ বলেছেন, “বাংলা ভাষা ও বাঙালি জনগণের উপর আক্রমণের বিরুদ্ধে আমাদের ১৯টি কর্মসূচি আগে থেকেই নির্ধারিত ছিল। এই হামলায় তৃণমূলের কোনো কর্মী জড়িত নয়।” তৃণমূল এই ঘটনাকে বিজেপির ‘অভ্যন্তরীণ কোন্দল’ এবং ‘সুনিপুণ নাটক’ বলে বর্ণনা করেছে।
রাজনৈতিক পটভূমি: কেন এই উত্তেজনা?
এই হামলার পটভূমিতে রাজ্যের চলমান রাজনৈতিক উত্তেজনা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। শুভেন্দু অধিকারী সম্প্রতি জাতীয় নাগরিক তালিকা (এনআরসি) এবং বিশেষ নিবিষ্ট সংশোধন (এসআইআর) নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করেছেন। তিনি দাবি করেছেন, পশ্চিমবঙ্গে প্রায় এক কোটি ‘অবৈধ রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশি মুসলিম’ রয়েছে, এবং এসআইআরের মাধ্যমে তাদের ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেওয়া উচিত। এই মন্তব্য তৃণমূলের তীব্র প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছে, এবং তারা এটিকে ধর্মীয় বিভাজন সৃষ্টির প্রচেষ্টা হিসেবে দেখছে।
তৃণমূল নেতা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সম্প্রতি বোলপুরে ‘ভাষা আন্দোলন’ শুরু করেছেন, যেখানে তিনি বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতির উপর আক্রমণের অভিযোগ তুলেছেন। তৃণমূলের দাবি, বিজেপি এনআরসি ও এসআইআরের মাধ্যমে বাঙালি জনগণের পরিচয়ের উপর আঘাত করছে। এই পরিস্থিতিতে শুভেন্দুর কনভয়ে হামলা রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার একটি নতুন অধ্যায় হিসেবে দেখা হচ্ছে।
শুভেন্দু অধিকারী এই হামলাকে রাজ্যের আইনশৃঙ্খলার ‘সম্পূর্ণ পতন’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন,
“এই লজ্জাজনক হামলা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন সরকারের হতাশা প্রকাশ করে। আমি কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশ মেনে কোচবিহারে গিয়েছিলাম, এবং রাজ্য প্রশাসন আমার সূচি সম্পর্কে সম্পূর্ণ অবগত ছিল। তবুও এই হামলা প্রমাণ করে যে বিরোধী নেতার উপরও নিরাপত্তা নেই।” তিনি জেড ক্যাটাগরির নিরাপত্তা থাকা সত্ত্বেও এই ত্রুটির জন্য রাজ্য প্রশাসনকে দায়ী করেছেন।
বিশেষজ্ঞদের মতামত
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই হামলা ২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে রাজ্যের রাজনৈতিক উত্তেজনাকে আরও বাড়িয়ে তুলবে। কলকাতার রাজনৈতিক বিশ্লেষক প্রণব মুখোপাধ্যায় বলেন, “শুভেন্দু অধিকারীর এনআরসি ও এসআইআর সংক্রান্ত মন্তব্য রাজ্যে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বিভাজনকে উসকে দিয়েছে। তৃণমূল এই ইস্যুকে বাঙালি পরিচয়ের সঙ্গে জুড়ে দিয়ে ভোটারদের মধ্যে সমর্থন বাড়ানোর চেষ্টা করছে।” তিনি আরও বলেন, এই ধরনের হামলা রাজ্যের আইনশৃঙ্খলার দুর্বলতাকে প্রকাশ করে, যা বিজেপি তাদের প্রচারে ব্যবহার করতে পারে।
সামাজিক মাধ্যমে এই ঘটনা নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। বিজেপি সমর্থকরা এই হামলাকে ‘তৃণমূলের সন্ত্রাস’ বলে অভিহিত করছেন, যখন তৃণমূল সমর্থকরা দাবি করছেন যে এটি বিজেপির ‘নাটক’ এবং জনগণের মনোযোগ আকর্ষণের কৌশল। একজন কোচবিহারের বাসিন্দা বলেন, “এই ধরনের ঘটনা আমাদের শান্তিপূর্ণ এলাকায় উত্তেজনা সৃষ্টি করছে। আমরা চাই রাজনীতি শান্তিপূর্ণ হোক।”
কোচবিহারে শুভেন্দু অধিকারীর কনভয়ে হামলা পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক পরিস্থিতির ক্রমবর্ধমান উত্তেজনার একটি প্রতিফলন। বিজেপি ও তৃণমূলের মধ্যে অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগের এই ঘটনা রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তুলেছে। পুলিশ তদন্ত শুরু করেছে, তবে এই ঘটনার রাজনৈতিক প্রভাব ২০২৬ সালের নির্বাচনের আগে আরও তীব্র হতে পারে। এই পরিস্থিতিতে সব পক্ষের কাছে শান্তি ও সংযমের আহ্বান জানানো হচ্ছে।

